এনবিআর শুল্ক–করছাড় দেয় সাধারণ ভোক্তা ও শিল্পোদ্যোক্তাদের সুবিধা পাওয়ার জন্য। এসব শুল্ক ও করছাড়ে সার্বিকভাবে অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়ে, যদি সেটি সঠিকভাবে ব্যবহার করা যায়। আবার দীর্ঘদিন শুল্ক ও করছাড়ের নেতিবাচক দিকও আছে। আমাদের উন্নয়ন সহযোগীরা যে বরাবরই শুল্ক ও করছাড়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে থাকে, তার পক্ষেও যথেষ্ট যুক্তি আছে। মূল কথা হলো কর ও শুল্কছাড়ের সুবিধা বৃহত্তর জনগোষ্ঠী পাচ্ছে কি না।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চলমান ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ কর্মসূচির আওতায় এনবিআরকে নানা ধরনের শর্ত ও লক্ষ্য দেওয়া হয়েছে। সংস্থাটি করছাড় কমানোর পাশাপাশি কয়েক দশক ধরে যে কর অব্যাহতি দেওয়া হচ্ছে, তা বাতিলের জন্য চাপ দিয়েছে। বিদ্যমান সব ধরনের করছাড় ২০২৭ সালের ১ জুলাইয়ের আগে তিন ধাপে বাতিল করারও পরামর্শ দিয়েছে তারা।
২০২৩ সালে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত এতই ভঙ্গুর অবস্থায় ছিল যে সরকারের জন্য আইএমএফের শর্ত না মেনে উপায় ছিল না। সম্প্রতি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কিছুটা বাড়লেও বিপদ পুরোপুরি কেটেছে বলা যায় না। এ অবস্থায় সরকারের অবস্থা শাঁখের করাতের মতো। আইএমএফের শর্ত না মানলে ঋণ পাওয়া যাবে না। আবার শর্ত মানলে অর্থাৎ শুল্ক–কর না কমালে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাবে। এ কারণেই নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় সরকারকে দফায় দফায় শুল্ক–কর কমাতে হয়েছে।
প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দেশে বছরে প্রায় পৌনে তিন লাখ কোটি টাকার শুল্ক-করছাড় দেয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। আয়কর যা আদায় হয়, তার চেয়ে বেশি করছাড় দেওয়া হয়। মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট ও শুল্কের ক্ষেত্রেও করছাড়ের পরিমাণ প্রায় আদায়ের কাছাকাছি।
প্রশ্ন হলো, এই কর ও শুল্কছাড়ের সুবিধা ভোক্তাসাধারণ কতটা পেয়েছেন? গত কয়েক মাসে সরকার চাল, চিনি, আলু, ভোজ্যতেল, পেঁয়াজ ইত্যাদি পণ্যের ওপর শুল্ক কমিয়েছে, কোনো কোনোটির শুল্ক পুরোপুরি প্রত্যাহার করা হয়েছে। কিন্তু বাজারে এর প্রভাব তেমন পড়েনি। সোজা কথায়, যে উদ্দেশ্যে আমদানি শুল্ক কমানো হয়েছে, সেটি সফল হয়নি।
এনবিআর প্রণীত তিনটি প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায় আয়কর, ভ্যাট, সম্পূরক শুল্ক, আমদানি শুল্ক ও আবগারি শুল্ক মিলিয়ে এক অর্থবছরে ২ লাখ ৭৩ হাজার ৪১০ কোটি টাকার ছাড় দেওয়া হয়েছে। কেবল আইএমএফ নয়, সরকারের নীতিনির্ধারকদের মাঝেও কর ও শুল্কছাড় নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সম্প্রতি এনবিআরের ভ্যাট দিবসের অনুষ্ঠানে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদও করছাড়ের সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, ‘গত ৫০ বছর আমরা করছাড় দিয়ে শিশু (শিল্প ও বাণিজ্য) লালন–পালন করছি; আর কতকাল লালন করব?’
এর মাধ্যমে উপদেষ্টা ভবিষ্যতে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বাবলম্বী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁর এই পরামর্শের সঙ্গে দ্বিমত করার সুযোগ নেই। কিন্তু শিল্প খাতে অবকাঠামোগত সমস্যাগুলো দূর করতে না পারলে উৎপাদন যেমন ব্যাহত হবে, তেমনি পণ্য উৎপাদন খরচও বাড়বে। বিশেষ করে শিল্পাঞ্চলে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখা ও নিয়মিত গ্যাস–বিদ্যুৎ সরবরাহ নির্বিঘ্ন করার কাজটি সরকারকেই করতে হবে।
অন্যদিকে আমদানি পণ্যের ওপর শুল্কছাড়ের পরও কেন পণ্যের দাম কমছে না, সেটাও খতিয়ে দেখতে হবে। সম্প্রতি আমদানিকারকেরা বাজারে কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে ভোজ্যতেলের দাম লিটারপ্রতি আট টাকা বাড়িয়ে নিয়েছেন।
সরকার পণ্যের ওপর যে শুল্ক–কর কিংবা ভ্যাট কমাচ্ছে, তার সুফল যাতে সাধারণ মানুষ পায়, সরকারকে সেই ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে নিয়মিত বাজার তদারকি যেমন জরুরি, তেমনি আমদানি পণ্যের বাজার গোষ্ঠীবিশেষের নিয়ন্ত্রণ থেকে বের করে আনার বিকল্প নেই।