সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

র‍্যাব হেফাজতে নারীর মৃত্যু

বিচার বিভাগীয় তদন্ত হোক

প্রতারণার অভিযোগ পাওয়ার পর র‍্যাব সদস্যরা একজন সুস্থ নারীকে তুলে নিলেন এবং তিনি তাঁদের হেফাজতে থাকতে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। এরপর দুই হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে জানা গেল ওই নারী আর ইহজগতে নেই। তিনি হলেন নওগাঁর একটি ইউনিয়ন ভূমি অফিসের সহকারী সুলতানা জেসমিন। আর অভিযোগকারী হলেন রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের পরিচালক এনামুল হক।

র‍্যাব সদস্যরা যখন সুলতানা জেসমিনকে আটক করেছেন, তখনো কিন্তু অভিযোগকারী তাঁর বিরুদ্ধে থানায় মামলা করেননি। মামলা করেছেন পরদিন, যখন সুলতানা জেসমিন র‍্যাব হেফাজতে অচেতন অবস্থায় রাজশাহী মেডিকেলের আইসিইউতে। মামলা করার আগে কাউকে হেফাজতে নেওয়ার বিধান নেই। সুলতানা জেসমিনের আটক ও মৃত্যু তাই অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।

গণমাধ্যমের খবর থেকে জানা যায়, দাপ্তরিক কাজে বুধবার রাজশাহী থেকে নওগাঁয় যাচ্ছিলেন এনামুল হক। পথে র‍্যাবের একটি টহল দলের দেখা পেলে তিনি নিজের একটি সমস্যার কথা দলের ইনচার্জকে বলেন। সঙ্গে সঙ্গে র‌্যাব অভিযান চালিয়ে সুলতানা জেসমিনকে আটক করে।

পরদিন বৃহস্পতিবার রাজশাহী জেলার রাজপাড়া থানায় যে মামলা হয়েছে, তাতে জেসমিনের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ আনা হয়েছে। বলা হয়েছে, জেসমিনসহ কয়েকজন এনামুল হকের পরিচয় ও পদবি ব্যবহার করে ভুয়া ফেসবুক আইডি খোলেন। এরপর চাকরি দেওয়ার নামে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে টাকাপয়সা হাতিয়ে নিয়েছেন।

তবে জেসমিনের মামা নাজমুল হক বলেন, তাঁর ভাগনি মোবাইল ও কম্পিউটার ঠিকমতো ব্যবহারই করতে পারতেন না। এ জন্য অফিসের সহকর্মীদের কাছে তাঁকে কথা শুনতে হতো। তাঁর যে জীবনাচরণ ছিল, তাতে অন্যের নামে ফেসবুক আইডি খুলে প্রতারণা করা অসম্ভব। এ মামলায় জেসমিন ছাড়াও মো. আল আমিন (৩২) নামের একজনকে আসামি করা হয়েছে। তাঁর বাড়ি চাঁদপুরের হাইমচরে। আল আমিন সম্পর্কে সুলতানা জেসমিনের স্বজনেরা বলছেন, এই নামের কারও সঙ্গে সুলতানার পরিচয় ছিল, এটা তাঁদের জানা নেই। মামলায় অজ্ঞাতনামা আরও দু-তিনজনকেও আসামি করা হয়েছে।

যেহেতু মামলা করার আগেই র‍্যাব জেসমিনকে আটক করেছে, তাই এই আটককে আইনসম্মত বলা যাচ্ছে না। এভাবে আটক করার পর যখন জেসমিনকে হাসপাতালে নিতে হয় এবং শেষ পর্যন্ত তিনি মারা যান, তখন এ নিয়ে র‍্যাবের ব্যাখ্যায় আস্থা রাখা কঠিন।

র‍্যাব বলেছে জিজ্ঞাসাবাদে জেসমিন প্রতারণার বিষয়টি স্বীকার করেছেন এবং জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। প্রশ্ন হচ্ছে যে র‍্যাব কীভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করল যে জেসমিন অসুস্থ হয়ে পড়লেন। আর র‍্যাবের দাবি অনুযায়ী জেসমিন প্রতারক হলেও তাদের হেফাজতে মৃত্যুর বিষয়টি কোনোভাবেই বৈধতা পায় না।

সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর ঘটনায় উদ্বেগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছে কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠন। তারা বলেছে, মামলা দায়েরের আগে আটক, বেআইনি জিজ্ঞাসাবাদ ও পুলিশকে না জানানো সংবিধান, মানবাধিকারের মূলনীতি, উচ্চ আদালতের নির্দেশনা ও বিদ্যমান আইনের লঙ্ঘন। আর এটি ক্ষমতার অপব্যবহারের নিকৃষ্ট উদাহরণ। তাদের অভিমত, আগের ঘটনাগুলোর আইনগত প্রতিকার না হওয়ায় বারবার একই ঘটনা ঘটছে।

এর আগেও পুলিশ ও র‍্যাবের হেফাজতে অনেক মানুষ মারা গেছেন। কিন্তু পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না। এতে ধারাবাহিকভাবে কেবল মানবাধিকারই লঙ্ঘিত হচ্ছে না, দেশের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ন হচ্ছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে প্রায়ই বলা হয়, ব্যক্তির অপকর্মের দায় বাহিনী নেবে না। সে ক্ষেত্রে প্রকৃত ঘটনা উদ্‌ঘাটনে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করা প্রয়োজন। আর সেটি হতে হবে বিচার বিভাগীয় তদন্ত। নিজ বাহিনীর কাউকে দিয়ে তদন্ত করলে প্রকৃত সত্য বেরিয়ে আসবে না।