সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

‘খুশি’ করার পদোন্নতি: প্রশাসনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে

পদোন্নতি বা পদোন্নয়ন বলতে কোনো কর্মী বা কর্মকর্তাকে তাঁর বর্তমানে আসীন পদ থেকে উচ্চতর দায়িত্ব ও পদমর্যাদাসম্পন্ন পদে উন্নীত করাকে বোঝায়। কিন্তু পদ না থাকা সত্ত্বেও বিপুলসংখ্যক সরকারি কর্মকর্তার পদোন্নতির উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। 

প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, গত সোমবার রাতে দুটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ২২১ জন উপসচিব ও সমপদমর্যাদার কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিয়ে যুগ্ম সচিব করা হয়েছে। এর আগে পদ না থাকলেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কর্মকর্তাকে যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছিল। গত মে মাসে ১১৪ জন অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। অক্টোবরে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ২৯তম ব্যাচকে (চাকরিতে যোগদান ২০১১) পদোন্নতি দেওয়া হবে বলে জনপ্রশাসন সূত্রে জানা গেছে।

আগামী বছরের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। তার আগে পদ না থাকতেও এত বেশিসংখ্যক কর্মকর্তার পদোন্নতি দেওয়া হলো কেন? জনপ্রশাসনে পদায়ন ও পদোন্নতি হয় চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে কর্মকর্তাদের যোগ্যতা, দক্ষতা, অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে। অনুমোদিত পদের চেয়ে অনেক বেশিসংখ্যক কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আগের পদেই কাজ করতে হবে অথবা বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) হয়ে থাকতে হবে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা সূত্রে জানা গেছে, জনপ্রশাসনে যুগ্ম সচিবের অনুমোদিত পদের সংখ্যা ৩৩২। গত বছরের নভেম্বরে ১৭৫ জনকে যুগ্ম সচিব করার পর এই পদে কর্মকর্তার সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ৭২৫। এই পদে সর্বশেষ সোমবার রাতে ২২১ জনকে পদোন্নতি দেওয়ার পর যুগ্ম সচিবের সংখ্যা দাঁড়াল ৯৪৬। এখন দেশে অনুমোদিত পদের চেয়ে যুগ্ম সচিবের সংখ্যা প্রায় তিন গুণ।

এ ব্যাপারে মন্ত্রিপরিষদের সাবেক সচিব আলী ইমাম মজুমদারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বলেন, এটা রাজকোষের অপচয়, পদ দিলেও তাঁদের প্রয়োজনীয় কাজ দিতে পারবে না মন্ত্রণালয়। এতে জনপ্রশাসনে বিশৃঙ্খলা দেখা দেওয়াও অস্বাভাবিক নয়। পদোন্নতি পেয়েও যাঁরা পদ পাননি আর যাঁরা আগে থেকে ওই পদে আসীন আছেন, তাঁদের মধ্যে সন্দেহ-অবিশ্বাস তৈরি হবে।

জনপ্রশাসনে পদায়ন ও পদোন্নতি হয়ে থাকে প্রশাসনিক লোকবল কাঠামো অনুযায়ী। সেখানে পদ শূন্য সাপেক্ষে নতুন কর্মকর্তা নেওয়ার কথা। কিন্তু পদ না থাকলেও বিশেষ বিবেচনায় পদোন্নতি দেওয়ার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। যেকোনো দেশের জনপ্রশাসন হয় পিরামিড আকৃতির। অর্থাৎ যতই ওপরের দিকে যাবে, লোকবল কমে আসবে। কিন্তু আমাদের নীতিনির্ধারকেরা উল্টো পিরামিড পদ্ধতিতে চলতে অভ্যস্ত।

আরও উদ্বেগের বিষয় হলো পদ ছাড়া পদোন্নতির এই সংস্কৃতি কেবল জনপ্রশাসনেই সীমিত নেই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতেও একই পদ্ধতি পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে। নির্বাচন সামনে রেখে যখন বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন করছে, তখন এ রকম খুশি করার পদোন্নতি কাম্য হতে পারে না।

আমরা আশা করব, প্রশাসনিক জনবলকাঠামোকে উপেক্ষা করে কর্মকর্তাদের ‘খুশি করার’ পদোন্নতি দেওয়া থেকে সরকার বিরত থাকবে। যখন যতগুলো পদ শূন্য হবে, তখন ততগুলো পদেই পদোন্নতি দিতে হবে।  যে জনগণের করের অর্থে প্রশাসন চলে, সেই প্রশাসন থেকে তারা কী সুবিধা পাচ্ছে, সেটাই মূল বিবেচ্য বিষয় হতে হবে।