সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

দূষণের দায় বিসিক এড়াতে পারে না

জলবায়ু পরিবর্তন এবং নির্বিচার পাহাড় কাটা ও স্থাপনা নির্মাণ, প্রাকৃতিক বন উজাড় করে বাগান সৃজন—এসব নানা কারণে পার্বত্য তিন জেলায় সাম্প্রতিক বছরগুলোয় পানির তীব্র হাহাকার দেখা দিয়েছে। তিন পার্বত্য জেলায় প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী এখনো সুপেয় পানির জন্য প্রাকৃতিক ছড়া ও ঝরনার ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। সংবাদমাধ্যমের খবরে প্রায়ই আসে, বহুদূরের পথ পেরিয়ে ও পাহাড় ডিঙিয়ে সেখানকার বাসিন্দাদের পানি সংগ্রহ করতে হয়।

অথচ সেই ঝরনা ও ছড়ার পানিদূষণের যে সংবাদ আমরা দেখতে পাচ্ছি, তা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এতে ডায়রিয়া, কলেরার মতো পানিবাহিত রোগগুলো সেখানে শুধু প্রাণঘাতী হিসেবেই আবির্ভূত হচ্ছে না, সেখানকার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা তথা অস্তিত্বের সংকটও তৈরি করছে।

প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, রাঙামাটি সদর উপজেলার সাপছড়ি ইউনিয়নের মানিকছড়ি এলাকার একটি ছড়ায় ফোর স্টার রবার অ্যান্ড লেটেক্স নামের একটি রবার কারখানার বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। মানিকছড়ি নামে পরিচিত এই ছড়া অন্তত নয়টি গ্রামের মানুষের দৈনন্দিন ব্যবহারের পানির একমাত্র উৎস। বর্জ্য ফেলার কারণে ছড়াটির প্রায় পাঁচ কিলোমিটার অংশে পানি সাদা রং ধারণ করেছে। দুর্গন্ধযুক্ত হওয়ায় এসব পানি গৃহস্থালির কোনো কাজে ব্যবহার করতে পারছেন না এলাকার বাসিন্দারা। ছড়ায় প্রায়ই মরা মাছ ভেসে উঠছে।

মানিকছড়ি ছড়ার দূষণের প্রভাব বহুমাত্রিক। কেননা সরাসরি কাপ্তাই হ্রদের সঙ্গে মিশেছে। এ কারণে সেটি কাপ্তাইয়ের পানিদূষণও ঘটাচ্ছে। শুধু দৈনন্দিন কাজ নয়, দুই পারের কয়েক শ একর কৃষিজমির সেচের উৎসও ছড়াটি। অথচ কারখানাটি বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) শিল্প এলাকায় অবস্থিত।

প্রশ্ন হচ্ছে বিসিকের শিল্প এলাকার একটি কারখানা কীভাবে ইটিপি প্ল্যান্ট ছাড়া গড়ে উঠতে পারে? রাঙামাটি ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের কর্তাব্যক্তিদের বক্তব্য স্পষ্টত দায়সারা গোছের। প্রায় দুই বছর ধরে কারখানাটি থেকে পরিশোধন ছাড়াই বর্জ্য ফেলে ছড়ার পানিদূষণ করা হচ্ছে। স্থানীয় জনসাধারণ তাঁদের কাছে অভিযোগও দিয়েছেন। অথচ তাঁরা বলছেন, ‘আমরা কারখানার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারি না। আমরা শুধু প্লট ভাড়া দিয়েছি।’

এমন তো নয়, কারখানা কর্তৃপক্ষ অস্বীকার করেছে যে তারা ছড়ায় বর্জ্য ফেলছে না। তাদের ভাষ্য, তাদের কারখানার বর্জ্য পানিদূষণ করে না। যেখানে মাছ ও জলজ প্রাণী মারা যাচ্ছে, সেখানে এই বক্তব্যের ভিত্তি কতটা।

সারা বিশ্বে শিল্পকারখানা থেকে নিঃসৃত বর্জ্যে পানি ও পরিবেশদূষণ ঠেকানোর একটা প্রতিষ্ঠিত উপায় হচ্ছে ইটিপির মাধ্যমে পরিশোধন করে তা পরিবেশে অবমুক্ত করা। বাংলাদেশে পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালাতেও শিল্প কারখানায় ইটিপির ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কারখানা স্থাপন করে ছড়া, ঝরনা, নদীতে বর্জ্য ফেলা শুধু আইনবিরোধীই নয়, সেটা আত্মঘাতীও। রবার কারখানার বর্জ্যে ছড়ার পানিদূষণের দায় বিসিক এড়াতে পারে না।