সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

সাগর–রুনি হত্যা মামলা

তদন্তকাজে টাস্কফোর্স যেন ব্যর্থ না হয়

বাংলাদেশে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। অসম্ভব হলো ন্যায়বিচার পাওয়া। একটি হত্যাকাণ্ডের পর সাড়ে ১২ বছর পার হলেও এর বিচার না হওয়াকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা যায়? এটা কি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিছক অদক্ষতা, না এর পেছনে আরও কোনো রহস্য আছে?

২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের ভাড়া বাসায় খুন হন সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি। সাগর সে সময় বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল মাছরাঙায় আর রুনি এটিএন বাংলায় কর্মরত ছিলেন। সাগর-রুনি হত্যার ঘটনায় রুনির ভাই নওশের আলম বাদী হয়ে রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করেন।

প্রথমে এই মামলা তদন্ত করছিল শেরেবাংলা নগর থানার পুলিশ। চার দিন পর মামলার তদন্তভার ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) কাছে হস্তান্তর করা হয়। দায়িত্ব পাওয়ার ৬২ দিনের মাথায় ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল হাইকোর্টে ব্যর্থতা স্বীকার করে ডিবি। এরপর আদালত র‍্যাবকে মামলাটি তদন্তের নির্দেশ দেন। তখন থেকে মামলাটির তদন্ত করছে র‍্যাব এবং তারা তদন্ত প্রতিবেদন জমার তারিখ ১১১ বার পিছিয়েছে।

সাগর–রুনি হত্যার পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেছিলেন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ঘাতকদের বিচারের আওতায় আনা হবে। এরপর
একাধিক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বদলালেও সাগর–রুনি হত্যা মামলার তদন্তকাজের অগ্রগতি হয়নি। 

র‍্যাবের ব্যর্থতার প্রেক্ষাপটে হাইকোর্টের আদেশ সংশোধন চেয়ে করা আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সোমবার বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি মুহাম্মদ মাহবুব-উল ইসলামের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ সাগর–রুনি হত্যা মামলার তদন্তে বিভিন্ন সংস্থার অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন টাস্কফোর্স গঠন করার নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে তদন্ত শেষে ছয় মাসের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

উল্লেখ্য, একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল হাইকোর্টের দেওয়া এক আদেশে মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছিল র‍্যাব। তদন্তের জন্য মামলাটি র‍্যাবের কাছে পাঠানোর এই আদেশ সংশোধন চেয়ে স্বরাষ্ট্রসচিবের পক্ষে হাইকোর্টে আবেদনটি করা হয়। পরবর্তী আদেশের জন্য আগামী বছরের ৬ এপ্রিল দিন ধার্য করেছেন আদালত।

আমরা হাইকোর্টের এই রায়কে স্বাগত জানাই। একই সঙ্গে আশাবাদী হতে চাই, প্রস্তাবিত নির্ধারিত সময়ে টাস্কফোর্স সাগর–রুনি হত্যার কাজ শেষ করে বিচারের পথ উন্মুক্ত করবে।

সাগর–রুনি হত্যার পর সাংবাদিক সমাজ পথ ও মতের পার্থক্য ভুলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলন করেছিলেন। কিন্তু এরপর আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করলাম, সেই আন্দোলন হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে যায়। কোনো কোনো মহল থেকে বলা হলো আন্দোলন করে সরকারকে বিব্রত করা যাবে না। সরকার কখন বিব্রত হয় আর কখন নন্দিত হয়, এই বাস্তবতাবোধ যাদের নেই, তাদের কাছে ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করা যায় না। বছরের পর বছর তদন্তকাজ ঝুলে থাকায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা সংস্থাই প্রশ্নবিদ্ধ হননি, প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছেন সরকারের নীতিনির্ধাকেরাও।

আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রীরা বারবার প্রতিশ্রুতি দিয়েও সাগর–রুনি হত্যার তদন্তকাজ শেষ করতে পারেননি। কেবল এই মামলা নয়, আরও অনেক চাঞ্চল্যকর মামলার তদন্তকাজ রহস্যজনক কারণে থেমে আছে। আশা করি, অন্তর্বর্তী সরকার সাগর–রুনি হত্যা মামলার তদন্তকাজটি নির্ধারিত সময় শেষ করে বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে জাতিকে মুক্তি দেবে। একই সঙ্গে এত দিন যাঁরা সাগর–রুনি হত্যা মামলা তদন্তের নামে টালবাহানা করেছেন, তাঁদেরও জবাবদিহির আওতায় আনার দাবি অযৌক্তিক হবে না।