সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

ধারাবাহিক অবনতি উৎকণ্ঠা বাড়ায়

জার্মানির বার্লিন থেকে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) যে দুর্নীতির ধারণাসূচক (সিপিআই) প্রতিবেদন-২০২৩ প্রকাশ করেছে, তা নিয়ে ক্ষমতাসীনেরা যত বিরূপ প্রতিক্রিয়াই দেখান না কেন, দুর্নীতির সূচকে ধারাবাহিক অবনমন আমাদের উদ্বিগ্ন না করে পারে না।

দুর্নীতির মাত্রা কোন দেশে কেমন, সে সম্পর্কে ধারণা দিতে প্রতিবছর প্রতিবেদন প্রকাশ করে টিআই। তাদের তথ্য অনুযায়ী, দুর্নীতির মাত্রার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান দশম। ২০২২ সালে ছিল ১২তম। ধারণাসূচকে দুর্নীতির সংজ্ঞা হচ্ছে, ব্যক্তিগত সুবিধা বা লাভের জন্য ‘সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার’। ধারণাসূচক অনুযায়ী, গত ১৬ বছরের মধ্যে বাংলাদেশে দুর্নীতির মাত্রা সবচেয়ে বেশি ছিল ২০২৩ সালে।

দুর্নীতির সূচকের এই ক্রমাবনতি আমাদের শূন্য দশকের কথা মনে করিয়ে দেয়। সেই সময় বাংলাদেশ পরপর পাঁচ বছর দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। এক বছর আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এবং চার বছর বিএনপি সরকারের আমলে।

টিআইয়ের তথ্য অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান আফগানিস্তান ছাড়া সবার নিচে। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাসহ অন্য দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে দুর্নীতির হার বেশি। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভুটানের স্কোর ৬৮, ভারত ও মালদ্বীপের ৩৯, নেপালের ৩৫, শ্রীলঙ্কার ৩৪, পাকিস্তানের ২৯ ও আফগানিস্তানের ২০। বাংলাদেশ পেয়েছে ২৪।

সূচকে ১০০ স্কোরের মধ্যে ৯০ পেয়ে সবচেয়ে কম দুর্নীতির দেশ হিসেবে তালিকার শীর্ষে আছে ডেনমার্ক। ৮৭ পেয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে ফিনল্যান্ড। তৃতীয় স্থানে নিউজিল্যান্ড, চতুর্থ স্থানে নরওয়ে। অন্যদিকে দুর্নীতির মাত্রা সবচেয়ে বেশি সোমালিয়ায়। তাদের স্কোর মাত্র ১১। দ্বিতীয় স্থানে আছে সাউথ সুদান, সিরিয়া ও ভেনেজুয়েলা।

বাংলাদেশে যে দুর্নীতি বেড়েছে, তা জানতে টিআই বা অন্য কোনো সংস্থার জরিপের প্রয়োজন হয় না। দুর্নীতির কারণেই প্রতিবছর হাজার কোটি টাকা দেশ থেকে পাচার হচ্ছে, ব্যাংকিং খাতের লুটপাটের তথ্য প্রায়ই সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে। কিন্তু দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, এ রকম উদাহরণ কম। যখন পি কে হালদারের মতো দুর্নীতিবাজের সঙ্গে সরকার কিংবা ব্যাংকিং খাতের অনেক হোমরাচোমরার সদ্ভাবের কথা জানা যায়, তখন শঙ্কিত হতেই হয়। রক্ষকেরা ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলে দুর্নীতি কমবে কীভাবে?

সরকারের নীতিনির্ধারকেরা নিশ্চয়ই দুর্নীতির বিষয়ে ওয়াকিবহাল এবং মাঝেমধ্যে এর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেন। কিন্তু বাস্তবে তঁারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে কতটা কঠোর হতে পেরেছেন, সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। টিআইএর প্রতিবেদন প্রকাশের পর ক্ষমতাসীন দলের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী যেভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন, তা কার্যত দুর্নীতিবাজদের প্রতি সহমর্মিতারই প্রকাশ। এর আগে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে টিআইবির প্রতিবেদন নিয়েও একাধিক মন্ত্রী ও নেতা উষ্মা প্রকাশ করেছেন।

টিআইবির চেয়ারপারসন সুলতানা কামাল টিআইএর প্রতিবেদন প্রকাশকালে বলেছেন, ‘যখন দুর্নীতি, মানবাধিকার নিয়ে কথা বলি, তখন তারা (সরকার) ষড়যন্ত্রের কথা বলে।’ কে কার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে? টিআই আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি প্রতিষ্ঠান। এর প্রতিবেদন নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা দুর্নীতিবাজদের আড়াল করার চেষ্টা ছাড়া কিছু নয়।

সরকার যদি সত্যি সত্যি দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরতে চায়, তাহলে এই ষড়যন্ত্রতত্ত্ব থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। কার আমলে কত বেশি দুর্নীতি হয়েছে, সেই পরিসংখ্যানের চেয়েও জরুরি হলো দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া এবং দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে প্রত্যেক দুর্নীতিবাজকে শাস্তির আওতায় আনা।

‘হাত দিলে হাত পুড়ে যাবে’—এমন আত্মঘাতী চিন্তা থেকেও নীতিনির্ধারকদের বেরিয়ে আসতে হবে।