সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

খাদ্যের মূল্যস্ফীতি

অধিকাংশ নিত্যপণ্যের দাম কেন ঊর্ধ্বমুখী

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে টোটকার মতো নেওয়া সরকারের বিচ্ছিন্ন পদক্ষেপগুলো যে কোনো কাজে আসেনি, অক্টোবরে খাদ্যের মূল্যস্ফীতির রেকর্ড তারই প্রমাণ দেয়। এটা অস্বীকার করার কোনো অবকাশ নেই যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, জ্বালানি ও খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, মার্কিন ডলারের বিনিময় হারের বড় উল্লম্ফন মূল্যস্ফীতির পেছনে ভূমিকা পালন করেছে।

কিন্তু মুদ্রানীতি, রাজস্ব নীতি ও বাজার ব্যবস্থাপনা—তিনটি ক্ষেত্রে সমন্বিতভাবে যে পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজন ছিল, তার অনুপস্থিতিই অর্থনীতির নীরব ঘাতক মূল্যস্ফীতিকে বাগে আনা যায়নি, সবার আগে সেই স্বীকৃতি প্রয়োজন।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাব বলছে, আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর—এই তিন মাস ধরেই খাদ্যের মূল্যস্ফীতি ১২ শতাংশের ওপরে রয়েছে। অক্টোবরে খাদ্যের মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ, যা গত ১১ বছর ৯ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর ফলে অক্টোবরে সার্বিক মূল্যস্ফীতিও বেড়েছে। বিশ্ববাজারে যখন অধিকাংশ খাদ্যপণ্যের দাম কমে এসেছে, সে সময় দেশের বাজারে অধিকাংশ নিত্যপণ্যের দাম কেন ঊর্ধ্বমুখী, সেই প্রশ্নের উত্তর কী?

প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, বাজারে এক মাসে চালের দাম কেজিতে ২ থেকে ৪ টাকা বেড়েছে। খুচরায় সবচেয়ে বেশি বেড়েছে মোটা ও মাঝারি মানের চালের দাম। এই দুই ধরনের চালের ভোক্তা মূলত নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত। তাদের পুষ্টিরও বড় অংশ আসে ভাত থেকে। ফলে চালের দাম বাড়লে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবনযাপনে বাড়তি সংকট তৈরি হয়। চালের সঙ্গে চিনির বাজারও চড়া। সরবরাহের সংকটকে দায়ী করে খোলা ও প্যাকেটজাত চিনি কেজিতে বেড়েছে অন্তত পাঁচ টাকা।

ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) পরিসংখ্যান বলছে, গত এক বছরে (৩১ অক্টোবর ২০২২ থেকে ৩১ অক্টোবর ২০২৩) নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে দেশি পেঁয়াজের দাম। এটির দাম ১৩২ শতাংশ বেড়েছে। আলুর দাম বেড়েছে ২০ শতাংশ।

অবশ্য বাজারে এ দুটি পণ্যের দাম কমতে শুরু করলেও যে গতিতে বেড়েছিল, সেই গতিতে কমছে না। এ ছাড়া রুই মাছের দাম বেড়েছে ৩৩ শতাংশ এবং ব্রয়লার মুরগি ও গরুর দাম বেড়েছে ১১ ও ১২ শতাংশ। মোটা দানার ডালের দামও বেড়েছে। সয়াবিন তেল ও আটার দাম কমলেও সেটা উচ্চ মূল্যে স্থিতিশীল।

আমদানিনির্ভর পণ্যের পাশাপাশি দেশি উৎপাদিত পণ্যের দামে অস্থিতিশীলতার পেছনে সরকারের মন্ত্রীরা সিন্ডিকেটের দিকে আঙুল তুললেও তাদের বিরুদ্ধে শক্ত ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি; বরং কৃষক ও ভোক্তার স্বার্থ সুরক্ষার বদলে সিন্ডিকেটের স্বার্থ রক্ষা হয়, এমন পদক্ষেপই বেশি নিতে দেখা যায়। উৎপাদনের সঠিক তথ্য না থাকা, সঠিক সময়ে আমদানির সিদ্ধান্ত না নেওয়া এবং যথাযথ বাজার তদারকি না থাকার কারণেই যে অসাধু ব্যবসায়ীরা ভোক্তার পকেট থেকে বাড়তি মুনাফা তুলে নেওয়ার সুযোগ পান, সেটা সবার কাছেই পরিষ্কার।

মূল্যস্ফীতি মানুষের জীবনযাত্রার ওপর সরাসরি আঘাত করে, এর সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী হন স্বল্প আয়ের মানুষেরা। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপ বাস্তবে কোনো কাজে আসেনি। ডলারের বিনিময় মূল্যের বড় উল্লম্ফন এবং দেশে চলমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি আরও শোচনীয় করতে পারে।

সে ক্ষেত্রে সরকারকে অবশ্যই মুদ্রানীতি ও রাজস্ব নীতির মধ্যে সমন্বয় করে সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। মুদ্রার বিনিময় হার ও সুদহার বাজারভিত্তিক করতে হবে। মুখে না বলে কাজে যে তারা সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে, তার দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। নিত্যপণ্যের দামে লাগাম টেনে ধরতে টোটকা নয়, বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ দেখতে চায় মানুষ।