যখন সরকারের রাজস্ব ও পুলিশ বিভাগের বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তাদের দুর্নীতি নিয়ে দেশে তোলপাড় চলছে, তখন ২০২৪–২৫ অর্থবছরের বাজেট পাসের দিন বিভিন্ন মঞ্জুরি দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কয়েকজন সংসদ সদস্য শিক্ষা খাতের দুর্নীতির বিষয়টি সামনে এনেছেন।
দেশি–বিদেশি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ও সংবাদমাধ্যম দুর্নীতির তথ্য–উপাত্ত তুলে ধরলে সরকারের নীতিনির্ধারকেরা আমলেই আনতে চান না। এবার খোদ জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের ও স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা শিক্ষা খাতে দুর্নীতির কঠোর সমালোচনা করেছেন। স্বতন্ত্র সদস্যরা ক্ষমতাসীন দলেরই লোক।
স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য (নাটোর-১) আবুল কালাম শিক্ষা খাতে ব্যাপক দুর্নীতির কথা উল্লেখ করে বলেন, টাকা দেওয়া ছাড়া কোনো শিক্ষক অবসর ভাতা পাচ্ছেন না। টাকা ছাড়া কিছুই হয় না। তিনি অনার্স-মাস্টার্স পাস ছেলেমেয়ের উপযুক্ত কর্মসংস্থানেরও দাবি জানান।
জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য হাফিজ উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, এমপিওভুক্তির জন্য বিভিন্ন টেবিলে যেতে হয়। ধাপে ধাপে টেবিল মানে ধাপে ধাপে দুর্নীতি। নিজ এলাকার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সেখানে একটি সরকারি বিদ্যালয়ে ৪৩টি শ্রেণিকক্ষ রয়েছে। কিন্তু পাঠদান হয় পাঁচটিতে! ঝিনাইদহ-২ আসনের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য নাসের শাহরিয়ার জাহেদী প্রশাসনিক ব্যয় কমিয়ে শিক্ষা–গবেষণায় ব্যয় বাড়ানো প্রস্তাব করেন। অপর স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য হামিদুল হক খন্দকার (কুড়িগ্রাম-২) বলেন, শিক্ষাব্যবস্থায় অনিয়ম, দুর্নীতি, বৈষম্য লেগেই আছে।
জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় সরকারের আগ্রহ যত প্রবল, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার ভিত মজবুত করার বিষয়ে ততটাই উদাসীন। শিক্ষার অভিভাবকেরা বুঝতে পারঝেন না শিকড় মজবুত না হলে ওপরে পানি ঢাললে কোনো লাভ হবে না।
বছর তিনেক আগে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) দেশের শিক্ষা খাত নিয়ে একটি গবেষণা করে। এতে উঠে এসেছে দেশের মাধ্যমিক শিক্ষায় এমপিওভুক্তি, নিয়োগ, বদলি, পাঠদানের অনুমতিসহ বিভিন্ন কাজে ৫ হাজার থেকে শুরু করে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়মবহির্ভূত (ঘুষ) দিতে হয়। ঘুষ নিয়ে থাকেন সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটি ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা।
২০১০ সালে ঘোষিত জাতীয় শিক্ষানীতিতে শিক্ষা প্রশাসনে কাঠামোগত পরিবর্তন আনার কথা বলা হয়েছিল। যুগের চাহিদা মেটাতে পারে এমন শিক্ষাক্রম চালু এবং উপযুক্ত শিক্ষক নিয়োগের ওপর জোর দেওয়া হয়েছিল। এরপর শিক্ষাক্রম ও প্রশ্ন নিয়ে নানা রকম পরীক্ষা–নিরীক্ষা হলেও শিক্ষার মানের ক্রমাবনতি ঠেকানো যায়নি।
বর্তমান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তিকরণ বন্ধ আছে। কিন্তু ইতিপূর্বে এমপিওভুক্তি নিয়ে ঘুষ–দুর্নীতির যেসব গুরুতর অভিযোগ এসেছে, সেগুলো তদন্ত করে দেখা জরুরি। একজন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান পদ না পাওয়ায় খেদ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু সংসদ সদস্যরা এই পদে থেকে যে কী পরিমাণ দুর্নীতি করেছেন, সেই হিসাবও তাঁদের দিতে হবে।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শিক্ষা খাতে বাংলাদেশে বরাদ্দের হার সবচেয়ে কম। আবার সেই কম বরাদ্দ নিয়েও যতি দুর্নীতির মচ্ছব চলে তাহলে শিক্ষার দুরবস্থা কাটবে কীভাবে? শিক্ষাকে বাঁচাতে হলে শিক্ষা খাতে ঘুষ–দুর্নীতি বন্ধের বিকল্প নেই।
টিআইবির প্রতিবেদন প্রকাশের পর তৎকালীন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী শিক্ষা প্রশাসনে দুর্নীতিকে চ্যালেঞ্জ বলে অভিহিত করে কাঠামোগত পরিবর্তন আনার ওপর জোর দিয়েছিলেন। এখন তিনি পূর্ণমন্ত্রী। কী করে শিক্ষা খাতে দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা হবে, সেটা তাঁকেই খুঁজে বের করতে হবে।
অন্যদের কথা আমলে না নিলেও অন্তত সংসদ সদস্যদের কথা শুনুন।