সরকারের নানা পদক্ষেপ ও পরিকল্পনা সত্ত্বেও বাংলাদেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশের যে উন্নতি হয়নি, সেটা আবারও উঠে এসেছে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সাম্প্রতিক জরিপে। বুধবার বাংলাদেশ ব্যবসায় পরিবেশ ২০২৩-এর উদ্যোক্তা জরিপের ফলাফল প্রকাশ করতে গিয়ে প্রতিষ্ঠানটি ১৭টি সমস্যার কথা জানায়। এর মধ্যে শীর্ষে আছে দুর্নীতি। প্রায় ৬৮ শতাংশ ব্যবসায়ী উচ্চ মাত্রার দুর্নীতির এ সমস্যাকে এক নম্বর হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। দ্বিতীয় স্থানে আছে অদক্ষ আমলাতন্ত্র।
অন্যান্য সমস্যার মধ্যে আছে বৈদেশিক মুদ্রার অস্থিতিশীলতা, অপর্যাপ্ত অবকাঠামো, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, অর্থায়নের সীমাবদ্ধতা, জটিল করনীতি, বারবার নীতি পরিবর্তন, দক্ষ শ্রমশক্তির অভাব, উদ্ভাবনের সক্ষমতায় ঘাটতি, শ্রমশক্তিতে দুর্বল নৈতিকতা, উচ্চ করহার, জলবায়ু পরিবর্তন, সরকারের অস্থিতিশীলতা, অপরাধ ও চুরি, বিধিনিষেধমূলক শ্রম আইন ও দুর্বল স্বাস্থ্যব্যবস্থা।
এর আগে বাংলাদেশ বিজনেস ক্লাইমেট ইনডেক্স (বিবিএক্স) ২০২২-২৩ জরিপে বলা হয়েছিল, ব্যবসায়ীদের ব্যাংকঋণ পাওয়া জটিল হয়েছে। কর ও ভ্যাট পরিশোধে হয়রানি আগের চেয়ে বেড়েছে। এ ক্ষেত্রে দুই ধরনের সমস্যা আছে। ছোট ব্যবসায়ীরা সব শর্ত পূরণ করার পরও ঋণ পান না। আবার প্রভাবপ্রতিপত্তি খাটিয়ে ঋণ নিয়ে বড় ব্যবসায়ীদের ফেরত না দেওয়ারও অনেক উদাহরণ আছে।
২০২৩ সালে দেশে ব্যবসায় পরিবেশ কেমন ছিল, সেটাই বিশ্লেষণ করা হয়েছে সিপিডির জরিপে। গত বছরের মে-জুলাই সময়ে ঢাকা, গাজীপুর ও সাভারের বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ৭১ শীর্ষ কর্মকর্তার মতামত নেওয়া হয়। সিপিডির গবেষণা জরিপে একজন ব্যবসায়ীর বরাতে বলা হয়েছে, তিনি একটি পরিষেবা সংযোগ নিতে আবেদন করলে তাঁর কাছে যে পরিমাণ ঘুষ চাওয়া হয়েছিল, তা তাঁর পরিকল্পিত বিনিয়োগের সমপরিমাণ।
এ ধরনের ঘটনা আগেও অনেক ঘটেছে। অনেক সময় মোটা অঙ্কের উৎকোচের বিনিময়ে ব্যবসায়ীরা গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি ইত্যাদি পরিষেবা সংযোগ নিতে বাধ্য হন। কেননা কারখানার নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার পর উৎপাদনে না গেলে তাদের আরও বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়।
সরকারের উচিত হবে সিপিডির জরিপ ধরে যে প্রতিষ্ঠান পরিষেবা সংযোগ দেওয়ার বিনিময়ে উৎকোচ দাবি করেছে, সেই প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া। সিপিডির জরিপে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, দীর্ঘসূত্রতা ও অদক্ষতার কথা বলা হয়েছে।
যেখানে সরকার স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার কথা বলছে, সেখানে কেন ব্যবসা-বাণিজ্যে এই করুণ অবস্থা থাকবে? অনেক বছর আগেই সরকার ওয়ান–স্টপ সার্ভিস বা এক ঘরে সব সেবা দেওয়ার কথা বলেছিল। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সেটা হয়নি।
সিপিডির জরিপে বেরিয়ে এসেছে, বড় ব্যবসায়ীরা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে উৎকোচ দিয়ে ব্যবসা চালিয়ে নিলেও ছোট ও মাঝারিদের পক্ষে সেটা অনেক সময় সম্ভব হয় না। তাহলে কি ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা ব্যবসা ছেড়ে দেবেন?
বিদেশিদের প্রতি আরও বেশি বিনিয়োগ করার জন্য সরকারের নীতিনির্ধারকেরা প্রায়ই আহ্বান জানিয়ে থাকেন। এশিয়ায় ব্যবসার পরিবেশের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড এমনকি ভারতের থেকেও অনেক পিছিয়ে আছে। এ অবস্থায় বিদেশি বিনিয়োগকারীরা কেন আসবেন?
সরকার মুখে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার কথা বলবে, আর সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য ব্যবসায়ীদের মাসের পর মাস অপেক্ষা করতে হবে, এটা চলতে পারে না। সিপিডি স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি যেসব সুপারিশ করেছে, সেগুলো আমলে নিয়ে সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে ব্যবসার পরিবেশ কিছুটা হলেও উন্নত হবে।