সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

চট্টগ্রাম ও পাহাড়ে বন্যা

উপদ্রুত মানুষের ত্রাণ ও পুনর্বাসন জরুরি

সাম্প্রতিক বন্যা-বৃষ্টি দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও বান্দরবানের ওপর দিয়ে যেভাবে ধ্বংসচিহ্ন রেখে গেল, সেটা ছিল অনেকটা নজিরবিহীন। চট্টগ্রাম শহরের বিস্তীর্ণ অঞ্চলও ডুবে যায়, সৃষ্টি হয় ভয়াবহ জলাবদ্ধতা। অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবানের দুটি উপজেলার অধিকাংশ ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে, যার মধ্যে আছে সরকারি-বেসরকারি অফিস ও বসতবাড়ি।

এ ছাড়া বন্যার পানির তোড়ে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার নির্মাণাধীন রেললাইন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, রেললাইনের জন্য উঁচু বাঁধ নির্মাণের কারণেই বৃষ্টির পানি নামতে না পেরে বন্যার সৃষ্টি হয়েছে। বন্যা ও পাহাড় ধসে নারী, শিশুসহ অর্ধশতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে কয়েক শ কোটি টাকার।

প্রথম আলোর প্রতিনিধিদের খবর থেকে জানা যায়, ইতিমধ্যে বন্যার পানি অনেকটাই সরে গেছে। চট্টগ্রাম শহরের জীবনযাত্রাও স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। কিন্তু দক্ষিণ চট্টগ্রামের চন্দনাইশ, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া ও আনোয়ারা, কক্সবাজারের চকরিয়া এবং পার্বত্য জেলা বান্দরবানের জনজীবনের বিপন্ন দশা কাটেনি।

সাতকানিয়া, চন্দনাইশ ও চকরিয়ার অনেক জায়গায় ঘরের চাল পর্যন্ত ডুবে যায়। স্থানীয় বয়োজ্যেষ্ঠরা বলছেন, তাঁদের জীবদ্দশায় এমন পানি তাঁরা দেখেননি। পাহাড়ে বান্দরবানের পরিস্থিতি সবচেয়ে শোচনীয়। সেখানে পানি দোতলা পর্যন্ত উঠে যায়। ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় জেলাটিতে এখনো অনেক মানুষ আশ্রয়শিবিরে আছেন। বন্যায় বান্দরবান পানি শোধনাগার ও বিদ্যুৎ অফিস ডুবে যায়।

বন্যাকবলিত এলাকায় সুপেয় পানি ও খাবারের সংকট দেখা দিয়েছে। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থাগুলো ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করলেও তা অপ্রতুল। নিত্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলায় মাথাপিছু যে ত্রাণ বরাদ্দ করা হয়েছে, তা সামান্যই বলা যায়।

বান্দরবানে রুমা ও থানচি উপজেলার সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় প্রত্যন্ত অঞ্চলে ত্রাণসামগ্রী পৌঁছানো যাচ্ছে না। এই দুই উপজেলার মানুষের চলাচলের একমাত্র উপায় এখন নৌপথ। এ সুযোগে ইঞ্জিনচালিত নৌকার মালিকেরা ভাড়াও বাড়িয়ে দিয়েছেন। প্রথম আলোর প্রতিনিধিরা সরেজমিন দেখতে পেয়েছেন, বন্যাকবলিত রুমা ও থানচি উপজেলায় প্রায় পুরোটাই বিধ্বস্ত। দুই উপজেলার মানুষের এখন বড় সমস্যা হলো কর্মসংস্থান। স্থানীয় লোকজন বলেছেন, তাঁরা কত দিন ত্রাণসামগ্রী নিয়ে চলবেন? দোকানপাটগুলো মেরামত করা হলে দ্রুত তাঁরা ব্যবসা শুরু করতে পারেন।

উল্লেখ্য, দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর গত মাসে সরকার রুমা ও থানচি পর্যটকদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছিল। এখন বন্যার আঘাতে সেখানকার পর্যটন ব্যবসা আবারও ধাক্কা খেল। আবাসিক হোটেলসহ বেশির ভাগ স্থাপনা ডুবে যায়। ফলে কবে নাগাদ পর্যটনকেন্দ্রগুলো চালু করা যাবে, তা নিয়ে উৎকণ্ঠিত পর্যটন ব্যবসায়ীরা।

এ অবস্থায় সরকার ও স্থানীয় প্রশাসনকে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের কাছে পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী পৌঁছাতে হবে। বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি মেরামতের জন্য তাদের আর্থিক সহায়তা দিতে হবে। জেলা শহরের সঙ্গে থানচি ও রুমার সড়ক যোগাযোগ পুনঃস্থাপনের কাজটিও করতে হবে তাড়াতাড়ি।

আগস্ট মাসের প্রথম কয়েক দিন জেলাগুলোতে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়েছে, এ কথা সত্য। কিন্তু পরিবেশবিদদের মতে, অপরিকল্পিত উন্নয়ন, নির্বিচার পাহাড় নিধন ও বনজঙ্গল ধ্বংস করার কারণেই বন্যার প্রকোপ এতটা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। ভবিষ্যতে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে যতটা সম্ভব পাহাড় ও বন রক্ষা করেই করতে হবে। ওই অঞ্চলের নদীগুলো রক্ষায় সচেষ্ট হতে হবে।

রেললাইনের সুরক্ষার পাশাপাশি স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবন–জীবিকার বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে। রেললাইনের জন্য তৈরি উঁচু বাঁধের কারণে যদি বন্যা প্রকট আকার ধারণ করে, তাহলে পানি সরে যাওয়ার বিকল্প ব্যবস্থা করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভবিষ্যতে বন্যার প্রকোপ আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। উন্নয়ন ও যোগাযোগ—দুটিই মানুষের জন্য। তাদের জীবন বিপন্ন করে কোনো উন্নয়ন হতে পারে না। আশা করি, সরকারের নীতিনির্ধারকেরা বিষয়টি ভেবে দেখবেন।