সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

তৈরি পোশাকশিল্প

যৌথ ঘোষণার বাস্তবায়ন জরুরি

নিম্নতম মজুরি, হাজিরা বোনাস, মামলা প্রত্যাহারসহ ১৮টি বিষয়ে তৈরি পোশাক খাতের মালিক ও শ্রমিকেরা যে সমঝোতায় পৌঁছেছিলেন, দেড় মাস পরও সেগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অগ্রগতি না হওয়া উদ্বেগজনক। বকেয়া বেতনের দাবিতে রোববার ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করায় ভয়াবহ যানজটের সৃষ্টি হয়। হাজার হাজার যানবাহন ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকা পড়ে।

শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে গত ১৩ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত ‘শ্রম অসন্তোষ পরিস্থিতি পর্যালোচনা’ শীর্ষক আন্তমন্ত্রণালয় সভায় শ্রমিক ও মালিকপক্ষের যৌথ ঘোষণা হয়। এতে তারা ১৮টি বিষয়ে সমঝোতায় পৌঁছায়।

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর শিল্পাঞ্চলে ব্যাপক শ্রমিক বিক্ষোভ দেখা দেয়, যার মূল কারণ শ্রমিকদের দীর্ঘদিনের বঞ্চনা। গত বছর ঘোষিত নতুন মজুরিকাঠামো নিয়েও শ্রমিকদের অসন্তোষ ছিল। এরপর আবার শ্রমিকদের বকেয়া পাওনা না দিয়েই কিছু মালিক কারখানা বন্ধ করে দেন। এর প্রতিবাদে থেমে থেমে শ্রমিক বিক্ষোভ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে তাঁদের সংঘর্ষ হয়। শ্রমসচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান মনে করেন যে কয়েকটি কারখানায় এখনো মজুরি বকেয়া রয়েছে, সেখানেই ঝামেলা হচ্ছে।

শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিজিএমইএর সদস্যভুক্ত ২ হাজার ১৪০টি কারখানার মধ্যে ২ হাজার ১২১টি নিম্নতম মজুরি বাস্তবায়ন করেছে। বাকি ১৯টির বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াধীন। এ ছাড়া সমঝোতায় পৌঁছানো ১৮টি বিষয়ের অন্যতম ছিল শ্রম আইন সংশোধন করা। এটি ডিসেম্বরের মধ্যে করার কথা বললেও মার্চ পর্যন্ত সময় পিছিয়ে নিয়েছে সরকার। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, তিনটি বিষয়ে শ্রম আইন সংশোধন হওয়ার কথা—শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিত করা, তাঁদের সার্ভিস বেনিফিট দেওয়া ও নারী শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন ছুটি ১২০ দিন করা।

গত ২৪ সেপ্টেম্বর থেকে অনেক কারখানা ১২০ দিন মাতৃত্বকালীন ছুটি দেওয়া শুরু করেছে। সংশোধিত আইনে অস্থায়ী ও দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে চাকরি করা শ্রমিকদের ইস্তফা দেওয়ার সুযোগের কথা আছে। সমঝোতা বৈঠকে শ্রমিকদের জন্য রেশনব্যবস্থা চালু করতে মালিকদের কাছে প্রস্তাব দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। পাশাপাশি সব পোশাক কারখানায় শ্রমিকের হাজিরা বোনাস, টিফিন ও নাইট বিল বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত হয়।

প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, বেশ কিছু সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলেও রেশনের বিষয়ে কোনো অগ্রগতি নেই। ২০২৩ সালের আন্দোলনসহ বিভিন্ন সময়ে শ্রমিকদের বিরুদ্ধে করা মামলাগুলোও প্রত্যাহার করা হয়নি। শ্রমিক সংগঠন সূত্রে জানা গেছে, এসব মামলার অভিযোগপত্রও (চার্জশিট) দাখিল হয়নি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে থানাগুলোতে চিঠি দিয়েই মামলাগুলো প্রত্যাহার করা যেত। কিন্তু সেটা করা হয়নি।

শিল্পাঞ্চলে শ্রমিক অসন্তোষ বন্ধ করতে হলে তাঁদের ন্যায্য দাবিদাওয়া পূরণ করতে হবে। শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি পরিশোধ না করে কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। ঊর্ধ্বমূল্যের বাজারে যেখানে শ্রমিকেরা নিয়মিত মজুরি পেয়েও চলতে পারেন না, সেখানে মজুরি বাকি থাকলে তাঁরা চলবেন কীভাবে?

শ্রমিকদের বকেয়া বেতন পরিশোধ না হওয়া সম্পর্কে শ্রমিক অধিকার-সংক্রান্ত গবেষণাপ্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান আহমেদ বলেছেন, ‘ক্ষুধার্ত মানুষ চুপ করে থাকতে পারে না।’ শ্রমিকেরা দুমুঠো খাবারের জন্যই কারখানায় কাজ করেন। তাঁদের ক্ষুধার্ত রেখে শিল্পাঞ্চলে শান্তি ও স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হলে শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা পরিশোধসহ ১৮ দফা যৌথ ঘোষণা অবিলম্বে বাস্তবায়ন জরুরি।