দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহির মধ্যে আনা হোক

বিএনপি সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদন না করে হাজার হাজার খাম্বা বসিয়ে জনগণের অর্থের অপচয় করেছে বলে আওয়ামী লীগ অভিযোগ করত। এ অভিযোগ পুরোপুরি অসত্য নয়। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগও ক্ষমতায় এসে একই পথে চলেছে। জ্বালানির সংস্থান না করেই অতিরিক্ত বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করেছে, গ্যাসের সংস্থান না করে বসিয়েছে নতুন নতুন গ্যাসের পাইপলাইন।

প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে খুলনা ও রাজশাহীতে নেওয়া হয়েছে গ্যাসের পাইপলাইন। তবে নতুন সংযোগ হয়েছে খুব কমই। রংপুরে নেওয়া নতুন লাইনে গ্যাস সরবরাহের কোনো নিশ্চয়তা নেই।

দেশের মোট গ্যাস সরবরাহের ৭৫ শতাংশ সঞ্চালন করে জিটিসিএল। পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহ হলে সঞ্চালন চার্জ পায় জিটিসিএল। এটিই তাদের আয়ের একমাত্র উৎস। গ্যাস সরবরাহ কমলে আয়ও কমে যায়। দিনে তাদের গ্যাস সঞ্চালন সক্ষমতা ৫০০ কোটি ঘনফুট, সরবরাহ করে মাত্র ২০০ কোটি ঘনফুট।

হাজার হাজার কোটি টাকায় গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণ করে গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড (জিটিসিএল) বিরাট লোকসানে পড়েছে। ১৯৯৩ সালের ৪ ডিসেম্বর কোম্পানি নিবন্ধন নিয়ে যাত্রা শুরু করে জিটিসিএল। ওই সময় পাইপলাইন ছিল ৫৪৪ কিলোমিটার। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সংস্থাটি লোকসান করেছে ১ হাজার ২১২ কোটি টাকা।

২০২২-২৩ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদনে জিটিসিএলের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক রূখসানা নাজমা ইছহাক বলেন, ‘প্রকল্পসমূহ মূলধনিকরণের ফলে ঋণের সুদ ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। অপর দিকে অবচয় বৃদ্ধি এবং সিস্টেম লস অন্তর্ভুক্ত করার কারণে কোম্পানির ক্ষতির পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে।’

দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে গ্যাস সরবরাহের জন্য দুটি সঞ্চালন লাইন তৈরি করতে দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি খরচ হয়েছে। সিরাজগঞ্জের হাটিকুমরুল থেকে পাবনার ঈশ্বরদী হয়ে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা গেছে পাইপলাইন। আরেকটি প্রকল্পের অধীনে ভেড়ামারা থেকে খুলনায় নেওয়া হয়েছে গ্যাসলাইন। অন্যদিকে গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত না করেই খুলনায় ৮০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার গ্যাসচালিত একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে।

পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্রনাথ সরকার পাইপলাইন প্রকল্পের পক্ষে যে সাফাই গেয়েছেন, তা–ও ধোপে টেকে না। তিনি বলেছেন, ওই সময় গ্যাস উৎপাদন বাড়ানোর যে পরিকল্পনা করা হয়েছিল, তা এগোয়নি। গ্যাস উৎপাদন না বাড়িয়ে এই যে পাইপলাইন তৈরি করে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করা হলো, অথচ জনগণ কোনো সুবিধা পেল না, এর দায় কে নেবে?

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানিবিষয়ক বিশেষ সহকারী ম তামিম এসব প্রকল্পকে যথার্থই বাজে বিনিয়োগ ও রুগ্‌ণ প্রকল্প বলে অভিহিত করেছেন। উন্নয়নের জন্য খুলনা ও রাজশাহী অঞ্চলে গ্যাস সরবরাহের দাবি বহু পুরোনো। গ্যাস–সংকটের কারণে সেখানে শিল্পকারখানা গড়ে উঠছে না, এটাও সত্য। কিন্তু আগে তো সরকারকে গ্যাসের সংস্থান করতে হবে, সেটা বাসাবাড়িতে হোক কিংবা শিল্পকারখানায়।

সে ক্ষেত্রে সরকারের উচিত ছিল নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধান ও উত্তোলনের প্রতি মনোযোগ দেওয়া। কিন্তু তারা বিদেশ থেকে গ্যাস কিনে বেশি দামে জনগণের কাছে বিক্রি করতে যতটা উৎসাহী ছিল, গ্যাস অনুসন্ধানে ততটাই নির্বিকার ছিল। গ্যাসের সংস্থান না করে দীর্ঘ পাইপলাইন বসানো সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষের সঙ্গে ধাপ্পাবাজি ছাড়া কিছু নয়। যারা এই ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থ উদ্ধারে রাজনৈতিক বিবেচনায় পাইপলাইন বসিয়ে রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকা অপচয় করেছে, তাদের অবশ্যই জবাবদিহির আওতায় আনা হোক।