সরকার গ্যাস অনুসন্ধান, আহরণ ও উত্তোলনকে গুরুত্ব না দিয়ে বিদেশ থেকে সস্তায় তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করে ক্রেতাদের কাছ থেকে বাড়তি দাম নিয়ে লাভ করেছে। জ্বালানি খাতে তাদের ভুল নীতির খেসারত এখন দেশবাসীকে দিতে হচ্ছে। এর ফলে দেশের মানুষ যেমন চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ পাচ্ছেন না, তেমনি ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নামে বিশেষ গোষ্ঠীকে সুবিধা করে দিয়েছে। আবার এর বিরুদ্ধে কেউ যাতে আদালতের শরণাপন্ন না হতে পারেন, সে জন্য ২০১০ সালে দায়মুক্তি আইনও পাস করা হয়েছিল।
যেখানে দেশে বিদ্যুতের চাহিদা ১৪ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট, সেখানে ২৬ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার কী যুক্তি থাকতে পারে? যদি পুরো চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন করাও হয়, সে ক্ষেত্রে কেন্দ্রের সক্ষমতা ১৬ হাজার মেগাওয়াট হলেই যথেষ্ট।
১১ জুলাই প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, একটি টার্মিনাল বন্ধ থাকায় প্রায় দেড় মাস ধরে এলএনজি সরবরাহ কম। এর মধ্যে মঙ্গলবার রাতে এক দুর্ঘটনায় পাইপলাইন ছিদ্র হয়ে গেছে। এতে এলএনজি সরবরাহ আরও কমে গেছে। গ্যাস-সংকটে পড়েছে শিল্প, আবাসিক ও বিদ্যুৎ খাত। একাধিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। দেশে বেড়ে গেছে লোডশেডিং।
দেশে দিনে গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে দেশি ও বিদেশি উৎস থেকে ৩০০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হয়। কক্সবাজারের মহেশখালীতে দুটি ভাসমান টার্মিনালের মাধ্যমে এলএনজি থেকে আসে ১১০ কোটি ঘনফুট। এখন এ দুটি টার্মিনাল থেকে সরবরাহ হচ্ছে ২৫ কোটি ঘনফুট। ফলে গ্যাস সরবরাহ নেমে এসেছে ২২৫ কোটি ঘনফুটে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগে কোনো টার্মিনাল বন্ধ থাকতে কিংবা ঠিকাদারি সংস্থার পক্ষ থেকে মাটি খোঁড়াখুঁড়ির সময় গ্যাসলাইন ছিদ্র হতে পারে। কিন্তু সেটি দ্রুত চালু ও মেরামতের চেষ্টা হবে না কেন?
গ্যাস সরবরাহ কমে যাওয়ায় কেবল শিল্পকারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে না, বাসাবাড়িতে গ্যাস সরবরাহ কমে যাওয়ায় ঢাকা শহরের বাসাবাড়িতে রান্নাও ঠিকমতো হচ্ছে না। কোনো কোনো এলাকায় মধ্যরাতের পর চুলায় গ্যাস আসে। দিনের বেলায় গ্যাস থাকে না। ঢাকার বাইরের অবস্থা আরও শোচনীয়।
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর যে উদ্যোগ নিয়েছিল, তাতে সবারই সমর্থন ছিল। কিন্তু বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর নামে একের পর এক রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। মাসের পর মাস বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো অলস বসিয়ে রেখে ক্যাপাসিটি চার্জের মাধ্যমে গোষ্ঠীবিশেষকে বিশেষ সুবিধা পাইয়ে দেওয়া হয়েছে।
উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির নামে সরকার দফায় দফায় বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়াচ্ছে। কিন্তু যে কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদনই হয় না, তার খরচ কেন গ্রাহক তথা জনগণ বহন করবেন?
বিশেষজ্ঞরা যখন বিদ্যুৎ–সংকট কাটাতে মাটির নিচে থাকা গ্যাস উত্তোলনের ওপর জোর দিয়েছিলেন, তখন সরকার আমলে নেয়নি। ভূতত্ত্ববিদ বদরূল ইমাম সম্প্রতি ক্যাবের আলোচনায় বলেছেন, সরকারের নীতিনির্ধারকেরা বিজ্ঞজনদের কথা শোনেন না। যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হলে দেশে আরও গ্যাস পাওয়া যেত। এসব না করে সহজ পথ হিসেবে এলএনজি আমদানির দিকে গেছে। এটি এখন জাতির জন্য মস্ত বড় বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।