ছাড়পত্র ছাড়া কারখানা

শ্রমিকেরা এভাবেই মারা যাবেন? 

গত বৃহস্পতিবার নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের রহিমা ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স লিমিটেডের কারখানায় লোহা গলানোর সময় চুল্লি বিস্ফোরণের ঘটনায় পাঁচ শ্রমিকের মৃত্যু কি শুধুই দুর্ঘটনা? দুর্ঘটনা তখনই বলা যায়, যখন সব ধরনের নিরাপত্তা সুরক্ষা থাকার পরও কোনো অঘটন ঘটে যায়। উল্লিখিত কারখানাটি চলছিল কোনোরকম নিয়মনীতি ছাড়াই। শ্রমিকদের সুরক্ষা পোশাক ছিল না। ছিল না অন্যান্য নিরাপত্তা সরঞ্জামও।

একটি কারখানা চলার জন্য কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেওয়া যে অত্যাবশ্যক, সেটাও তারা নেয়নি। 

প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, কারখানাটি এখনো নির্মাণাধীন। পরীক্ষামূলকভাবে লোহা গলানোর কাজ করা হচ্ছিল। আড়াইহাজার ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ বলছে, যেখানে ঘটনা ঘটেছে, সেখানে কোনো অগ্নিনির্বাপণযন্ত্র দেখতে পাননি তাঁরা। 

কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর নারায়ণগঞ্জ কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের শেষে কারখানাটি ছাড়পত্রের জন্য অধিদপ্তরের নারায়ণগঞ্জ কার্যালয়ে আবেদন করে। তারপর কারখানা পরিদর্শক খালিদ হাসান ও মেহেদী হাসান দুই দফায় কারখানা পরিদর্শন করেন। কারখানার শ্রেণি ও কাজের ধরন অনুযায়ী শ্রমিকদের ‘যথাযথ’ নিরাপত্তা না থাকায় তাঁরা কারখানাটিকে ছাড়পত্র না দিয়ে নিরাপত্তা জোরদারের সুপারিশ করেন। 

ওই দুই পরিদর্শক গত ৬ মার্চ সরেজমিন কারখানা পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। এ সময় কারখানার মেশিন লে-আউট, শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ, শ্রমিকদের নিরাপত্তাপোশাক যথাযথ না হওয়ায় তাঁরা প্রথমে মৌখিক ও পরে লিখিতভাবে নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য কারখানা কর্তৃপক্ষকে তাগিদ দিয়েছিলেন। এরপরও কারখানামালিক নিরাপত্তামূলক কোনো ব্যবস্থা ছাড়াই কারখানাটি চালিয়ে আসছিলেন। সে ক্ষেত্রে এটাকে নিছক দুর্ঘটনা বলে দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। 

কেবল রহিমা ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স লিমিটেড নয়, নারায়ণগঞ্জের আরও অনেক কারখানা চলছে নিয়মনীতি ছাড়াই। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে রূপগঞ্জে হাশিম ফুড কারখানায় আগুন লেগে ৫২ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়। ২০১৮ সাল থেকে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ ও ফতুল্লায় তিনটি স্টিল কারখানায় দুর্ঘটনা ঘটে; তিনটির ক্ষেত্রেই নিরাপত্তার মারাত্মক ঘাটতি ছিল। 

দুই পরিদর্শকের সতর্কবার্তার পরও রহিমা ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্সের মালিক কারখানাটি চালু রেখে কেবল স্বেচ্ছাচারিতা দেখাননি, শ্রমিকদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছেন। কারখানার শ্রমিকদের কেউ নিয়মিত ছিলেন না, সবাই ছিলেন অনিয়মিত। নিরুপায় হয়ে কারখানায় কাজ করতে এসে যাঁদের কেউ কেউ মারা গেলেন, কেউ কেউ আহত হলেন। 

নারায়ণগঞ্জের শিল্পাঞ্চলে বহু মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে, এটা খুবই আশাবাদের কথা। কিন্তু সেখানে কর্মরত শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি উপেক্ষিত থাকতে পারে না। রানা প্লাজার দুর্ঘটনার আগে এখানকার তৈরি পোশাক কারখানাগুলোতে ঘন ঘন দুর্ঘটনা ঘটত। নিয়মিত তদারকি ও প্রয়োজনীয় নিরাপত্তাব্যবস্থার কারণে তৈরি পোশাকশিল্পে দুর্ঘটনা অনেকটাই কমেছে। অন্যান্য কারখানায়ও তদারকি জোরদার করা প্রয়োজন। 

রহিমা ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স লিমিটেডে দুর্ঘটনার পর কারখানার মালিকপক্ষের কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাঁদের এ গা ঢাকা দেওয়ার কারণ কী? তাঁরা কি ভেবেছেন, শ্রমিকদের জীবনের কোনো দাম নেই? দুর্ঘটনার পর কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তর কারখানায় বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সংযোগ বিচ্ছিন্ন এবং কারখানাটি বন্ধ করে দিয়েছে। কেবল কারখানা বন্ধ নয়, যাঁরা নিয়মনীতি উপেক্ষা করে কারখানা চালু করেছিলেন, তাঁদের বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করাতে হবে। ভবিষ্যতে যাতে কোনো কারখানায় দুর্ঘটনা না ঘটে, সে বিষয়েও সংশ্লিষ্ট সবাইকে সর্বোচ্চ সজাগ থাকতে হবে।

দুর্ঘটনায় নিহত শ্রমিকদের পরিবারকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। যদিও আমরা জানি মানুষের জীবনের যে ক্ষতি, তা অর্থ দিয়ে পূরণ করা সম্ভব নয়।