সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

কার্যকর ও সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে

গত ৫ আগস্ট ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতার পালাবদলের পর অনেক কিছু পরিবর্তন হলেও ঢাকা শহরের যানজট পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের সড়ক অবরোধ করে কর্মসূচি পালন যানজটকে আরও নাজুক করে তুলেছে।

এই প্রেক্ষাপটে ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুজন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠকটি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। তাঁর আমন্ত্রণেই বিশেষজ্ঞরা এসেছেন।

বৈঠকে বিশেষজ্ঞরা রাজধানীর সড়কে যানজট কমাতে ছয়টি প্রস্তাব দেন, যার মধ্যে আছে মূল সড়কে প্যাডেল ও ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল বন্ধ রাখা, ট্রাফিক পুলিশকে সক্রিয় করা, সিগন্যালে গাড়ি বেশি সময় আটকে না রাখা ও সড়কে যানবাহন দাঁড় করিয়ে না রাখা।

বৈঠকে উপস্থিত বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মো. হাদীউজ্জামান বলেন, সরকারপ্রধানকে দীর্ঘমেয়াদি কয়েকটি সুপারিশ করা হয়েছে। এর একটি হলো, সব বাসকে একটি সরকারি কোম্পানির আওতায় আনতে বর্তমান মালিকদের কাছ থেকে বাস অধিগ্রহণ করতে হবে কিংবা তাঁরা কোম্পানির অংশীদার হিসেবে থাকবেন, ৭০ শতাংশ যাত্রীকে বাসসেবার আওতায় আনতে হবে। এর আগে এক সাক্ষাৎকারে তিনি ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা লাইফ সাপোর্টে আছে বলে অভিহিত করেছিলেন।

সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে যানজট পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে বলে ডিএমপির কর্মকর্তা যে তথ্য দিয়েছেন, তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। যতই দিন যাচ্ছে, যানজট আরও বাড়ছে। পরিবহন ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা–বিশেষজ্ঞ মোয়াজ্জেম হোসেনের উপস্থাপনা থেকে আমরা জানতে পারি যে ঢাকা শহরে যানজটে বছরে অন্তত ৪০ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়।

একটি মেগা সিটিতে শহরের আয়তনের ২৫ শতাংশ সড়ক থাকতে হয়। কিন্তু ঢাকায় আছে মাত্র ৮ শতাংশ। আবার সড়কের অনেক জায়গা দখলদারের দখলে থাকে, ময়লার ভ্যান, যত্রতত্র গাড়ি রেখে রাস্তা সংকীর্ণ করে ফেলা হচ্ছে। যানজট নিরসনে অবিলম্বে প্রাইভেট কারের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, চৌরাস্তাগুলোতে টানেল নির্মাণ, ছোট ছোট বিকল্প রাস্তা তৈরি করা, ট্রাফিক পুলিশের জনবল বাড়ানো, পথচারীদের ট্রাফিক আইন মেনে চলতে বাধ্য করার বিকল্প নেই। ফুটপাতসহ সব রাস্তা দখলমুক্ত করতে হবে।

বিগত সরকারের আমলে শহরে সমন্বিত যানবাহন চলাচলের উদ্যোগ নিয়েও সফল করা যায়নি স্বার্থান্বেষী মহলের চাপে। সমন্বিত পদ্ধতিতে বাস চালু করলে যানজট ও যাত্রীভোগান্তি যে কমানো যায়, গুলশান–হাতিরঝিল রুটই তার প্রমাণ। অন্যান্য রুটেও এটি দ্রুত চালু হওয়া দরকার। আশা করি, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ট্রাফিক কর্তৃপক্ষ চাপমুক্ত হয়ে কাজ করতে পারবে।

তবে বিশ্বের সবচেয়ে জনাকীর্ণ এই শহরের যানজট কমাতে এসব কারিগরি সমাধান যথেষ্ট নয়। প্রতিদিনই ঢাকা শহরে জনসংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু সেই তুলনায় আয়তন বাড়ানোর সুযোগ নেই। বর্ধিত জনসংখ্যা কেবল সড়কে যানজট সৃষ্টি করছে না, আবাসস্থল থেকে হাসপাতাল, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান—সব ক্ষেত্রেই চাপ বাড়াচ্ছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে ঢাকা শহর মানুষের বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে।

এই অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় হলো ঢাকামুখী জনস্রোত অবিলম্বে বন্ধ করা। সেটা তখনই সম্ভব হবে, যখন নাগরিকেরা ঢাকার বাইরে প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক সুবিধা ও উন্নত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা পাবেন।

 ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র সংস্কারে নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে। আশা করি, ঢাকা শহরের অসহনীয় যানজট ও জনজট কমাতে তারা প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণকেও সমানভাবে অগ্রাধিকার দেবে।