সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

ভয়াবহ বেকারত্ব

কাজের সঙ্গে শিক্ষার সংযোগ বাড়াতে হবে

বাংলাদেশে যে শিক্ষিত বেকারের হার বেড়ে চলেছে, সেটি বুঝতে কোনো পরিসংখ্যান বা গবেষণার প্রয়োজন হয় না। সরকারি কিংবা বেসরকারি যেকোনো প্রতিষ্ঠানে একটি পদের বিপরীতে চাকরিপ্রার্থী আবেদনকারীর সংখ্যা হিসাব করলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়।

গত জুলাই–আগস্ট মাসে কোটা সংস্কার আন্দোলন যে গণ–অভ্যুত্থানে রূপ নিয়েছে, তারও পেছনে প্রধান কারণ ছিল বেকারত্ব। বেসরকারি খাতে কাজের সুযোগ তেমন না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নেওয়ার পর মেধাবী তরুণেরা সরকারি চাকরিতেই বেশি ঝুঁকছেন। কিন্তু কোটার কারণে অনেক মেধাবী সেই চাকরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছিলেন বলেই আন্দোলন শুরু করেছিলেন তাঁরা।

শিক্ষিত তরুণদের বেকারত্বের একটি খণ্ডিত চিত্র পাওয়া যায় গত বছরের ডিসেম্বর থেকে চলতি বছরের মার্চের মধ্যে রেলওয়েতে দুই ধাপে ২ হাজার ১৭২ ওয়েম্যান নিয়োগের ঘটনায়। চতুর্থ শ্রেণির (১৯তম গ্রেড) ওয়েম্যান পদের মূল কাজ রেলপথ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা। লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার ধাপ পেরিয়ে যাঁরা এই পদে চাকরি পেয়েছেন, তাঁদের সবার শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি।

শনিবার নাগরিক প্ল্যাটফর্ম ভয়েস ফর রিফর্ম আয়োজিত ‘কর্মসংস্থান ও শিক্ষিত বেকার সংকট সমাধানে রাষ্ট্রের করণীয়’ শীর্ষক সংলাপে বেকারত্বের ভয়াবহ চিত্র উঠে আসে। সংলাপ থেকে জানা যায়, দেশে প্রতিবছর সব মিলিয়ে ২৪ লাখ তরুণ-তরুণী চাকরির বাজারে প্রবেশ করছেন। এর মধ্যে ৫ থেকে ১০ লাখ দেশের বাইরে যান, যাঁদের অধিকাংশই অদক্ষ। ভয়েস ফর রিফর্ম প্ল্যাটফর্মের সহ-আহ্বায়ক ও বিডিজবসের প্রতিষ্ঠাতা ফাহিম মাশরুর বলেন, বেকারত্বের সমস্যা যেকোনো দেশের অন্যতম মৌলিক সমস্যা।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) নিয়ম অনুসারে, যাঁরা সাত দিনের মধ্যে মজুরির বিনিময়ে এক ঘণ্টা কাজ করার সুযোগ পাননি এবং এক মাস ধরে কাজপ্রত্যাশী ছিলেন, তাঁদের বেকার হিসেবে গণ্য করা হয়। এর ভিত্তিতে বিবিএস দেশে বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ বলে উল্লেখ করেছে। তাদের এই হিসাবটা কেবল অবিশ্বাস্য নয়, হাস্যকরও। কেননা, সপ্তাহে এক ঘণ্টা কাজ করে কেউ চলতে পারেন না।

সংলাপে অর্থনীতিবিদেরা শিক্ষিত তরুণদের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে একাডেমিয়া ও উদ্যোক্তাদের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের কথা বলেছেন। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শ্রমবাজারে চাহিদা আছে, এমন শিক্ষিত ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জনশক্তি গড়ে তুলতে হবে। উদ্যোক্তারা বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে বিদেশ থেকে দক্ষ কর্মী নিয়ে আসবেন, আর আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বেকার তৈরি করবে, এটা হতে পারে না।

বেকারত্ব দূর করতে হলে আগামী পাঁচ–দশ বছরে আমাদের খাতভিত্তিক শ্রমবাজারের চাহিদা নিরূপণ করা জরুরি। একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কী ধরনের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী তৈরি করছে, সেটাও খতিয়ে দেখতে হবে। অর্থনীতিবিদেরা শ্রমবাজারভিত্তিক শিক্ষার ওপর জোর দিলেও অতীতে কোনো সরকার সেটা তেমন আমলে নেয়নি। তারা স্নাতকের সংখ্যা বাড়ানোকেই উন্নয়ন বলে চালিয়ে দিয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ও সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেছেন, কয়েক বছর ধরে ব্যাংকিং খাতে অস্থিরতা, বিনিয়োগে খরা, বাড়তি মূল্যস্ফীতি, অভ্যন্তরীণ সামষ্টিক চাহিদায় ধসের কারণে কর্মসংস্থান কমেছে।

অন্তর্বর্তী সরকার অনেক বিষয়ে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু তরুণ জনগোষ্ঠীর মেধা ও দক্ষতা কীভাবে কাজে লাগানো যায়, সে বিষয়ে টেকসই কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানা যায় না। চাকরিতে প্রবেশের বয়স দুই বছর বাড়ানো হয়েছে। বেকারত্ব লাঘবে তা খুব বেশি কাজে লাগবে না।

সরকারের অর্থনৈতিক কর্মপরিকল্পনায় কাজের সঙ্গে শিক্ষার সংযোগ বাড়াতে না পারলে বেকারত্ব আরও ভয়াবহ রূপ নেবে। আশা করি, সরকারের নীতিনির্ধারকেরা বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব দেবেন।