সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

এমপি-মন্ত্রীর চাপে রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয় কেন

পরিকল্পনা ছাড়াই অবকাঠামো নির্মাণ যেন বাংলাদেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ‘স্বাভাবিক’ চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় যোগাযোগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ প্রায় সব খাতেই এ প্রবণতা লক্ষণীয়ভাবে বেড়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা প্রভাব খাটিয়ে নিজেদের এলাকায় এ ধরনের প্রকল্প পাস করিয়ে নিচ্ছেন। সেবার চেয়ে অবকাঠামো নির্মাণের দিকেই আগ্রহ বেশি।

স্বাস্থ্য খাতে ভবন ও সেবার গাফিলতি নিয়ে প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, স্বাস্থ্য খাতে বিভিন্ন সময় নির্মিত ২৩৩টি স্থাপনা অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। এর মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের ৫৮টি ভবন ও স্বাস্থ্যশিক্ষা বিভাগের ১৭৫টি ভবন রয়েছে।

গণপূর্ত বিভাগ ও স্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ এসব ভবন নির্মাণ করেছে। গত সাত থেকে আট বছরে নির্মাণ করা ১৯৮টি ভবন তারা বুঝিয়ে দিলেও সেগুলো কবে চালু হবে, তা কেউ বলতে পারছে না।

প্রথম আলোর প্রতিনিধিরা মানিকগঞ্জ, কেরানীগঞ্জ, বরগুনা ও দাউদকান্দিতে এ ধরনের স্থাপনায় গিয়ে যে চিত্র দেখতে পেয়েছেন, তা অত্যন্ত হতাশাজনক। কেরানীগঞ্জে ২০ শয্যার হাসপাতালের উদ্বোধন ১৬ বছর আগে হলেও সেখানে এক দিনের জন্যও চিকিৎসাসেবা চালু করা যায়নি।

পরিত্যক্ত হাসপাতালটি থেকে ইট ও সিঁড়ির রেলিং কে বা কারা খুলে নিয়েছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা জানান, বিচ্ছিন্ন জায়গায় ও লোকালয় থেকে দূরে হাসপাতালটি অবস্থিত। এ রকম একটা জায়গায় হাসপাতাল নির্মাণের পেছনে সেবার চেয়ে রাজনৈতিক বিবেচনা বেশি ভূমিকা পালন করাটাই স্বাভাবিক।

বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নিজের এলাকা মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া, হিজুলি ও নয়াকান্দিতে অব্যবহৃত পড়ে আছে তিনটি বড় স্থাপনা। মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট ট্রেনিং স্কুল, ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনোলজি ও আঞ্চলিক জনসংখ্যা প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট তাঁর আমলে তৈরি হলেও সেগুলো চালানোর মতো জনবল, আসবাব ও যন্ত্রপাতি নেই।

সম্প্রতি প্রথম আলোয় শিক্ষা খাতে অপরিকল্পিতভাবে নির্মিত ভবন ও অবকাঠামো অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে রয়েছে, এ রকম একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। সড়ক ও সেতু নির্মাণের বিষয়টিও প্রায়ই খবরের শিরোনাম হচ্ছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, জনগণের অর্থ যেকোনোভাবে অপচয় করার আয়োজন সব খাতেই চলছে।

স্বাস্থ্য খাতের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, অনেক সময় ব্যক্তির ইচ্ছায় এসব স্থাপনা নির্মাণ করা হয়। মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা নিজ এলাকায় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ডিও লেটার দেন।

পরে প্রভাব খাটিয়ে তার অনুমোদন নিয়ে নেন। কিন্তু প্রয়োজনীয় জনবল, আসবাব ও যন্ত্রপাতির অভাবে তা চালু করা যায় না। একদিকে এভাবে প্রভাব খাটিয়ে বা চাপ প্রয়োগ করে প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করার কারণে বিপুল অর্থের অপচয় হচ্ছে, অন্যদিকে অনেক উপজেলায় চিকিৎসকদের জন্য ভালো আবাসন নেই।

বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে নগর ও মফস্‌সলের বৈষম্য প্রবল। স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার জন্য নিজেদের পকেট থেকে ৬৮ দশমিক ৫ শতাংশ টাকা ব্যয় করতে হয় এ দেশের মানুষকে। বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ জিডিপির সাড়ে ৫ শতাংশে আটকে আছে দীর্ঘদিন ধরে।

দুর্নীতির ওপর নজরদারি করা সংস্থা টিআইবি জানাচ্ছে, দুর্নীতির ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য খাতের অবস্থান ষষ্ঠ। প্রশ্ন হচ্ছে, এ পরিস্থিতিতে অপরিকল্পিতভাবে স্থাপনা নির্মাণ কিংবা জনগণের অর্থের অপচয় কাদের স্বার্থে?

অপরিকল্পিত স্থাপনা নির্মাণ করে জনগণের করের অর্থ অপচয়ের অপসংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে জনগণের অর্থ অপচয়ের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে তালিকা করে স্বাস্থ্যের পড়ে থাকা স্থাপনাগুলো চালুর ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। নাগরিকদের কোনোভাবেই সেবা থেকে বঞ্চিত করা যাবে না।