সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

পুলিশের মানসিক চাপ

মানসিক কাউন্সেলিং ইউনিট করা হোক

যখন পুলিশের সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তাদের দুর্নীতি-ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ে সংবাদমাধ্যমে ধারাবাহিক খবর প্রকাশিত হচ্ছে, তখনই এই বাহিনীর নিচের দিকের সদস্যদের মানসিক চাপের বিষয়টিও সামনে এসেছে।

সম্প্রতি ঢাকার কূটনৈতিক এলাকায় একজন কনস্টেবলের গুলিতে আরেক কনস্টেবল খুন হন। পরে জানা গেল, যে পুলিশ কনস্টেবল সহকর্মীকে খুন করেছেন, তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ ছিলেন। গত বছর ঢাকার বনানীর একটি তল্লাশিচৌকিতে দায়িত্ব পালনকালে পুলিশের এক সদস্য বুকে গুলি করে ‘আত্মহত্যা’ করেন। একই বছর পঞ্চগড়ে স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া করে ‘আত্মহত্যা’ করেন পুলিশের আরেক সদস্য।

প্রথম আলোর অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, পুলিশ বাহিনীর মধ্যম ও উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা অনেক সুযোগ-সুবিধা পেলেও নিচের স্তরের সদস্যরা নানাভাবে বঞ্চিত। তাঁদের নির্ধারিত কর্মঘণ্টার চেয়ে বেশি সময় কাজ করতে হয়, তাঁরা যে ব্যারাকে থাকেন, সেটা অস্বাস্থ্যকর। অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ব্যক্তিগত কর্মীর মতো আচরণ করেন, যা মানসিক পীড়নের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অতিরিক্ত ডিউটি, ছুটি ও পদোন্নতি না হওয়া এবং দীর্ঘদিন কম গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পদায়নের কারণে সদস্যদের একটি অংশ হতাশায় ভুগছে। 

চাকরির সব স্তরেই বৈষম্য আছে, কিন্তু পুলিশ বিভাগের বৈষম্য অনেক বেশি। ফলে নিচের স্তরের সদস্যদের একটা বড় অংশ মানসিক চাপে থাকে। প্রাপ্য ছুটি না পাওয়াও পুলিশ সদস্যদের একটা বড় সমস্যা। ঢাকার পুলিশ কনস্টেবলদের অধিকাংশই ব্যারাকে থাকেন এবং তাঁদের থাকা-খাওয়ার পরিবেশ অত্যন্ত খারাপ।

২০২০ সালে পুলিশ বাহিনীর সংস্কারের উদ্দেশ্যে যে গবেষণা করা হয়েছিল, তাতে নিচের স্তরের পুলিশ সদস্যদের সমস্যাগুলো উঠে আসে। ওই গবেষণার সুপারিশে তাঁদের স্বাস্থ্যসম্মত থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা, কর্মঘণ্টা নির্ধারণ ও ওভারটাইম ভাতা প্রদান, বার্ষিক ছুটি বাড়ানো, শহীদ পুলিশ সদস্যদের পরিবারের জন্য আজীবন রেশন-ব্যবস্থা চালু, রোগতত্ত্ব ইউনিট তৈরি, চিকিৎসাব্যবস্থার আধুনিকায়ন, শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছিল। এ ছাড়া ২৪ ঘণ্টায় তিন শিফটে ৮ ঘণ্টা কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করা, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে ছুটি, বিনোদন, খেলাধুলার সময় নির্দিষ্ট করার কথাও ছিল সুপারিশে। গত চার বছরেও এসব সুপারিশ বাস্তবায়িত না হওয়া প্রমাণ করে, নিচের স্তরের সহকর্মীদের সমস্যাকে ঊর্ধ্বতনেরা গুরুত্ব দেন না।

পুলিশে বছরে ২০ দিন সাধারণ (ক্যাজুয়াল লিভ) ও ৩৫ দিন অর্জিত ছুটি (আর্ন লিভ) রয়েছে। ১৫ দিনের ‘রেস্ট অ্যান্ড রিক্রিয়েশন লিভ’ রয়েছে তিন বছর পরপর। পুলিশ সদস্যরা যাতে এই ছুটিগুলো ঠিকমতো পান, সেদিকে গুরুত্ব দিতে হবে।

বিশেষজ্ঞ ও পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা বলছেন, মানসিক স্বাস্থ্য গঠনে পেশাগত কাউন্সেলিং ভালো ভূমিকা রাখে। পুলিশের মতো পেশাজীবীদের কাজের ফাঁকে গান শোনা জরুরি। মানসিক প্রশান্তির জন্যই বিভিন্ন পেশার বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে মতের আদান-প্রদান ও মাঝেমধ্যে ছুটি নিয়ে ঘুরতে যাওয়া দরকার। কাউন্সেলিংয়ের জন্য পুলিশে সাইকোলজি ইউনিট গঠনেও জোর দেন তাঁরা।

পুলিশ বিভাগের যেসব সদস্য মাঠপর্যায়ে কাজ করেন, তাঁদের ন্যূনতম কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। সব সুযোগ-সুবিধা ঊর্ধ্বতনদের না দিয়ে নিচের দিকেও নজর দেওয়া জরুরি। সরকারের নীতি এমন হওয়া উচিত নয় যে যাঁরা বেশি সুবিধা পাচ্ছেন, তাঁদের আরও সুবিধা দেওয়া হোক। আর যাঁরা কম পাচ্ছেন, তাঁদের বরাবর বঞ্চনার মধ্যে রাখা হোক।

যাঁরা দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত, তাঁদের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার বিষয়টি কোনোভাবে উপেক্ষণীয় নয়।  আশা করি সরকার পুলিশ বিভাগের সদস্যদের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার প্রতি নজর দেবে। প্রয়োজনে যাঁরা মানসিক চাপে ভুগছেন, তাঁদের মানসিক সুস্থতার জন্য আলাদা মানসিক কাউন্সেলিং ইউনিট করা হোক।