সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

আর কত নিচে নামলে আমাদের হুঁশ হবে

বাংলাদেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা যখন প্রত্যয় পেনশন স্কিম বাতিল ও উচ্চতর গ্রেডের দাবিতে আন্দোলন করছেন, তখনই একটি আন্তর্জাতিক র‍্যাঙ্কিংয়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নাজুক ও লাজুক চিত্র উঠে এল।

ইউএস নিউজ ও ওয়ার্ল্ড রিপোর্ট ২৪ সম্প্রতি ১০৪ দেশের ২০ হাজার ২৭১টি বিশ্ববিদ্যালয়ের র‍্যাঙ্কিং বা মান প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে দেখা যায়, ৫৫০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নেই। ৫৬০তম স্থানে আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ১ হাজার ৬৭৬ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ১ হাজার ৩৯৪তম, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় আছে যথাক্রমে ১ হাজার ৪১০ ও ১ হাজার ১৭৭তম স্থানে। এর আগে কিউএস র‍্যাঙ্কিংয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ছিল ৫৫৪।

ভারত ও পাকিস্তানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে তুলনা করলে আমাদের উচ্চশিক্ষার দীনতা সহজেই ধরা পড়ে। ভারতের ১৪০টি বিশ্ববিদ্যালয় ও পাকিস্তানের ৩২টি বিশ্ববিদ্যালয় আছে ওই তালিকায়। আন্তর্জাতিক গবেষণা, আঞ্চলিক গবেষণা, ছাত্র–শিক্ষক অনুপাত, গবেষণায় বরাদ্দ, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বকীয়তা ইত্যাদির ভিত্তিতে এই মানক্রম করা হয়।

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ও শিক্ষকেরা বলতে চান যে ইউরোপ–আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করা সমীচীন নয়। কেননা সেখানে শিক্ষার সুযোগ অবারিত এবং গবেষণায় প্রচুর বরাদ্দ থাকে। ইউরোপ–আমেরিকার সঙ্গে তুলনা করা না গেলেও ভারত ও পাকিস্তানের বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তুলনা করা নিশ্চয়ই অন্যায় হবে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তিন বছর আগেই শতবর্ষ পূরণ করেছে। শতবর্ষী এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে দেশবাসীর যে প্রত্যাশা, সেটি তারা কতটা পূরণ করতে পেরেছে? একদা দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে পরিচিত বুয়েটের মানেরই–বা এই অবনতি কেন? বাংলাদেশের আর্থসামাজিক পরিস্থিতি ভারত ও পাকিস্তান থেকে ভিন্ন নয়। কিন্তু শিক্ষার প্রতি সেখানকার সরকার, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও শিক্ষকদের দৃষ্টিভঙ্গি এক নয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা নিজেদের সুযোগ–সুবিধা বাড়ানোর দাবিতে আন্দোলন করছেন। এই আন্দোলনকে আমরা নেতিবাচকভাবে দেখতে চাই না। কিন্তু কেবল বেতন–ভাতা ও সুযোগ–সুবিধা বাড়ানোর দাবি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের একমাত্র কাজ হতে পারে না। আমরা আনন্দিত হতাম, যদি পেশাগত সুযোগ–সুবিধার পাশাপাশি তাঁরা শিক্ষার মানোন্নয়ন নিয়েও আন্দোলন করতেন।

বাংলাদেশের অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পদের বিপরীতে শিক্ষকের সংখ্যা কম। আবার পদের তুলনায় অধ্যাপকের সংখ্যা বেশি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা ঐতিহ্যবাহী ও বড় কলেজগুলোর সুযোগ–সুবিধা বৃদ্ধি না করে দেশে গত এক দশকে যে পরিমাণ বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলা হয়েছে, তা নিয়েও সমালোচনা আছে। এখনো অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামোই ঠিকঠাক গড়ে ওঠেনি। পড়াশোনার নানা সুযোগ–সুবিধার অভাবসহ শিক্ষকসংকট প্রকট। অন্যদিকে আগের তুলনায় বর্তমানে মেধার চেয়ে দলীয় বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগের মাত্রা অনেক বেড়েছে। নিয়োগ–বাণিজ্য নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সমালোচনার শেষ নেই। সেগুলোর বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থাও নেওয়া হয় না।

এমন পরিস্থিতি ও বাস্তবতায় উচ্চশিক্ষার মান কীভাবে বাড়বে? বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করে বের হয়ে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যাও বাড়ছে। বাস্তবমুখী ও গুণগত শিক্ষার ঘাটতি থাকায় বিশাল একটি উচ্চশিক্ষিত বেকার জনগোষ্ঠী তৈরি হচ্ছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ানোর চেয়ে উচ্চশিক্ষার মান বাড়ানোর নীতি গ্রহণের বিকল্প নেই। বেশি বেশি প্রতিষ্ঠান মানে বেশি বেশি প্রকল্প আর তাতে কিছু মানুষের পকেট ভারী হয়। জিডিপির তুলনায় শিক্ষায় বরাদ্দ বাড়াতে হবে। সেই বরাদ্দের সর্বোচ্চ ব্যবহার হতে হবে শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধিতে ও গবেষণা খাতে। রাষ্ট্র, রাজনীতি, সমাজের উন্নয়ন ও কল্যাণের জন্য উচ্চশিক্ষার মান বাড়াতে হবে। সরকার ও নীতিনির্ধারকদেরই তা উপলব্ধি করতে হবে।