বাংলাদেশের মানুষের জীবনের মূল্য যে কতটা সস্তা হতে পারে, অরক্ষিত রেলক্রসিংয়ে একের পর এক দুর্ঘটনা ও মৃত্যু তারই জীবন্ত দৃষ্টান্ত। এর সর্বশেষ নজির দেখলাম গত মঙ্গলবার সকালে। ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার কালিকাপুর এলাকায় রেলক্রসিংয়ে ট্রেনের ধাক্কায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার সাতজন নিহত হয়েছেন।
প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, কুমিল্লায় রেলপথে থাকা বৈধ রেলক্রসিংগুলোর চেয়ে অবৈধ ক্রসিংয়ের সংখ্যা বেশি। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বলছে, জেলার প্রায় ১২০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে থাকা রেলপথে অবৈধ রেলক্রসিংয়ের সংখ্যা শতাধিক। বছরের পর বছর ধরে এসব অবৈধ রেলক্রসিং মানুষের কাছে ‘মরণফাঁদে’ পরিণত হয়েছে। শুধু কুমিল্লা নয়, সারা দেশের রেলক্রসিংয়ের ক্ষেত্রে একই অবস্থা বিরাজমান।
প্রশ্ন হচ্ছে, রেললাইনের ওপর দিয়ে সড়ক যখন গেছে, তখন সেই ক্রসিং কেন অবৈধ হবে? কেন রেলক্রসিংগুলো এভাবে অরক্ষিত থাকবে? এর উত্তর হলো সড়ক, রেল, নৌ যোগাযোগ অবকাঠামো নির্মাণের সময় মানুষের জানমালের নিরাপত্তার বিষয়টি উপেক্ষা করে আসা হয়েছে। এখানে অবকাঠামো খাতের মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতার বিষয়টিও স্পষ্ট।
বিভিন্ন সংস্থা রেললাইনের ওপর দিয়ে সড়ক নির্মাণ করে। রেলওয়ে বলছে, যেসব সংস্থা রেলওয়ের কাছ থেকে অনুমতি না নিয়ে সড়ক নির্মাণ করে, সেসব ক্রসিং অবৈধ। এ কারণে এসব ক্রসিংয়ে কোনো গেট কিংবা গেটম্যান থাকে না। রেলওয়ের পক্ষ থেকে শুধু সতর্ক করে সাবধানে চলাচলের জন্য সাইনবোর্ড টানিয়ে দেওয়া হয়।
বাংলাদেশের অনেক রেল অবকাঠামো নির্মাণ হয়েছে ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে। গত তিন-চার দশকে দেশে সড়ক অবকাঠামোর প্রভূত উন্নয়ন হয়েছে। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের সঙ্গে পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদও অনেক সড়ক নির্মাণ করেছে। সেসব সড়ক অনেক ক্ষেত্রে রেললাইন অতিক্রম করেছে। কিন্তু রেলওয়ের আইন অনুযায়ী, তাদের অনুমতি না নিয়ে যদি কোনো সংস্থা সড়ক নির্মাণ করে, সেই রেলক্রসিংয়ে নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব তাদের নয়।
আমরা দেখছি, শুধু কুমিল্লাতেই অরক্ষিত রেলক্রসিংয়ের সংখ্যা শতাধিক। ফলে এসব আইনে থাকলেও সব ক্রসিংয়ে গেট তৈরি করা এবং গেটম্যান নিয়োগ দেওয়ার মতো সক্ষমতা রেলওয়ের নেই। এ ক্ষেত্রে অবকাঠামো খাতের মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে অবশ্যই একসঙ্গে বসে করণীয় ঠিক করতে হবে। স্থানীয় কমিউনিটিকে অন্তর্ভুক্ত করে কীভাবে অরক্ষিত রেলক্রসিংগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়, তার সমাধান বের করা জরুরি।
অরক্ষিত রেলক্রসিংয়ে মৃত্যুর ঘটনা নিশ্চিতভাবেই একটি কাঠামোগত ও অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ড। এই মৃত্যুর মিছিল অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।