সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

মহাপরিকল্পনা ছাড়া ভবন নির্মাণ নয়

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বৃক্ষনিধন, জলাশয় ভরাট আর প্রতিবেশঘাতী বহুতল ভবন নির্মাণবিষয়ক খবরের অগ্নিবৎ অকুস্থল তথা ‘হট স্পট’ হয়ে উঠেছে। গত কয়েক বছরের এ–জাতীয় পৌনঃপুনিক ঘটনার বিমূর্ত আয়নায় সেই বাস্তবতাই প্রতিফলিত হয়ে চলেছে।

পাঠশৈলীর অনন্যতা কিংবা পঠন-সাফল্যের খবর নিয়ে সংবাদমাধ্যমে এই বিদ্যায়তনের উপস্থিতি যতটা না থাকে, তার চেয়ে বেশি থাকে গণহত্যাসদৃশ নির্বিচার বৃক্ষনিধন ও তার প্রতিবাদমুখর উচ্চকিত আন্দোলনের সংবাদের জেরে। মাঝখানে সামান্য বিরতির পর সেই আন্দোলনাবহের প্রত্যাবর্তন ঘটেছে। যথারীতি এবারের বিষয়ও বৃক্ষনিধন ও জলাশয় ভরাটপূর্বক বহুতল ভবন নির্মাণের তোড়জোড়।

খবরে প্রকাশ, বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ১২টি স্থাপনার কাজ চলছে। ইতিমধ্যে ছয়টি ১০ তলাবিশিষ্ট হলের নির্মাণকাজ শেষ। এসব ভবন প্রতিষ্ঠার প্রতিবেশগত মূল্য পরিশোধে সহস্রাধিক বৃক্ষ নিধন করা হয়েছে। মহাপরিকল্পনা ব্যতিরেকে যত্রতত্র ভবন প্রতিষ্ঠারোধে কয়েক বছর ধরে আন্দোলন করছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের একটি অংশ। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দিক থেকে মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলাও হয়েছিল। কিন্তু সেটি আর আলোর মুখ দেখেনি।

এরই মধ্যে জলাশয় ভরাট করে গাণিতিক ও পদার্থবিষয়ক অনুষদের সম্প্রসারিত ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করা হয়েছে। অন্যদিকে আল-বেরুনী হলের সম্প্রসারিত ভবনের পার্শ্ববর্তী জলাশয়ের পারে চারুকলা বিভাগের ছয়তলাবিশিষ্ট বহুতল ভবন নির্মাণের কাজ শুরুরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মহাপরিকল্পনা ছাড়া এসব কাজ বন্ধের দাবি জানিয়ে আন্দোলন করছেন শিক্ষার্থীরা। তাঁদের ভাষ্য, মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের আগেই এসব ভবনের নির্মাণকাজ হবে প্রতারণার শামিল।

শেষোক্ত দুটি ভবন নির্মাণ নিয়ে যে আপত্তির উদ্ভব হয়েছে, তা পরিবেশসচেতন শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের কাছে যতটা যৌক্তিক ও উদ্বেগবাহী, প্রশাসনের কাছে ততটাই অমূলক ও উপেক্ষার বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে স্থানে চারুকলার ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তার পাশেই একটি জলাশয় রয়েছে, যেখানে ফি বছর অগুনতি পরিযায়ী পাখি আসে। সেখানে বহুতল ভবনের সদম্ভ উত্থানে এসব পাখির উড্ডয়ন অঞ্চল বিনষ্ট হবে। যেহেতু ‘মানুষ নিকটে এলে প্রকৃত সারস উড়ে যায়’, সেহেতু ভবন নির্মাণজনিত উচ্চ শব্দে নগরায়ণভীতিক্লিষ্ট পরিযায়ী পক্ষিকুল অন্যত্র চলে যাবে।

ফলত কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন বিদ্বজ্জনদের দ্বারা চালিত একটি সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের চত্বরে জলাশয় ভরাট করে ভবন নির্মাণের পরিবেশঘাতী সিদ্ধান্তের উৎপত্তিস্থল কোন কোন পণ্ডিতের মস্তিষ্কজাত হতে পারে, তা এক গবেষণার বিষয় হতে পারে।

স্বীকার্য যে কোটি কোটি টাকার অর্থকরী প্রকল্পের গল্পের মধ্যে জলাশয় ও পরিযায়ী পাখিবিষয়ক উপাখ্যান আর্থিক সুবিধাভোগীদের কাছে অতি অনর্থক কাব্য বলে প্রতীয়মান হতে পারে। কিন্তু তাদের কাজকারবারে মানুষ, পশুপাখিসহ যারা সামগ্রিকভাবে অসুবিধার শিকার হবে, তাদের ক্ষোভ-বিক্ষোভ কি মূল্যায়নবাচ্য হবে না?