সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

বিপিসি কি জবাবদিহির ঊর্ধ্বে

জাতীয় সংসদের জ্বালানি, বিদ্যুৎ ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) অনিয়ম, অদক্ষতা ও দুর্নীতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। গত মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত কমিটির বৈঠকে বিপিসির তিনটি অর্থবছরের অনিষ্পন্ন নিরীক্ষা (অডিট) আপত্তির কথা উঠে এসেছে, যাতে প্রায় সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকার অনিয়ম ধরা পড়ে। বৈঠক শেষে কমিটির সভাপতি আ স ম ফিরোজ মন্তব্য করেছেন, ‘বিপিসির অনিয়ম দেখে আমরা স্তম্ভিত হয়েছি।’

সংসদীয় কমিটির বৈঠকে বিপিসির ২০০৯-১০, ২০১০-১১ ও ২০১১—১২ অর্থবছরের অনিষ্পন্ন নিরীক্ষা আপত্তি নিয়ে আলোচনা হয়। কিন্তু পরবর্তী ১০ বছরে কী কী অনিয়ম হয়েছে, তা এখনো অজানা।

নিরীক্ষণ কমিটির বৈঠকে কমিটি দুই মাসের মধ্যে নিরীক্ষা অধিদপ্তরে নথিপত্র দিতে বিপিসিকে নির্দেশনা দিয়েছিল। কিন্তু তারা কমিটিকে কোনো নথিপত্র সরবরাহ করেনি। একটি আপত্তিতে হিসাব ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর বলেছে, বিপিসির স্থিতিপত্রে (ব্যালান্সশিট) বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও প্রকল্পকে দেওয়া ঋণের যে পরিমাণ দেখানো হয়েছে, তার সঙ্গে ওই সব প্রতিষ্ঠান বা প্রকল্পের স্থিতিপত্রে দেখানো অঙ্কে ২ হাজার ৫৯৭ কোটি টাকার গরমিল দেখা গেছে।

গত ২২ মে জাতীয় সংসদের সরকারি হিসাবসংক্রান্ত কমিটি হিসাবের গরমিলের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করলেও বিপিসির কাছ থেকে কোনো জবাব পাওয়া যায়নি। এটি তাদের ব্যর্থতা না অবজ্ঞা? আমরা আরও অবাক হই, দুদকের কথাও তারা শোনেনি। তারা কি নিজেদের জবাবদিহির ঊর্ধ্বে মনে করে? সংসদীয় বৈঠকে বিপিসি গত ১০ বছরের লাভ-ক্ষতির হিসাব তুলে ধরে। এতে বলা হয়, সাত বছরে (২০১৪-১৫ থেকে ২০২০-২১) বিপিসি ৫৭ হাজার কোটি টাকা মুনাফা করেছে। এর আগের তিন অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটি লোকসান দিয়েছে ১৪ হাজার কোটি টাকা। বিপিসির লাভের অর্থ জনগণের কাছ থেকেই নেওয়া হয়। অতএব কোন খাতে এই অর্থ ব্যয় হয়েছে, তা জানার অধিকারও তাদের আছে।

সংসদীয় কমিটির বৈঠকে আরও যেসব বিষয় বেরিয়ে এসেছে, তা-ও উদ্বেগজনক। ২০১২-১৩ অর্থবছরে দেশে মজুত ধারণক্ষমতার বেশি জ্বালানি তেল আমদানি করায় বাড়তি সময় জাহাজ ফ্লোটিং করে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে। এতে বিপিসির ৫০ কোটি টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। একই অর্থবছরে ব্যাংকে নিজস্ব তহবিল থাকা সত্ত্বেও ঋণ (ওভার ড্রাফট) নিয়ে কেনাকাটা করেছে, যাতে সুদ বাবদ প্রতিষ্ঠানের ২৪৮ কোটি ৯০ লাখ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।

বৈঠকে বিপিসির কর্মকর্তারা প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মধ্যে অনিয়মের সুযোগ নেই বলে সাফাই গাওয়ার চেষ্টা করেছেন। নতুন তেল পরিশোধনাগার প্রতিষ্ঠা না করা কিংবা তেল মজুত রাখার সক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা না করার কী যুক্তি থাকতে পারে? জাহাজ থেকে এখনো তেল খালাস করা হয় ম্যানুয়ালি। অন্যদিকে পাইপের মাধ্যমে তেল সরবরাহের উদ্যোগও অজ্ঞাত কারণে থেমে আছে। এতে প্রচুর তেল অপচয় হয়।

বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করতে সরকার সম্প্রতি রাশিয়া থেকে জ্বালানি তেল আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে। এখানেও সমস্যা শোধনাগারের। রাশিয়া থেকে আনা তেলের শোধনাগার বাংলাদেশে নেই। ফলে সেখান থেকে বেশি দাম দিয়ে পরিশোধিত তেলই আনতে হবে।

বিশেষজ্ঞদের কথা বিপিসি কখনো আমলে নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি। সংসদীয় কমিটির ভর্ৎসনার পরও তাদের চৈতন্যোদয় ঘটবে কি না, সেটাই প্রশ্ন।