সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হোক

১৫ জানুয়ারি প্রথম আলোয় ‘গুরুত্বপূর্ণ নৌপথে সেতু’ শিরোনামে প্রকাশিত খবরে যে তথ্য বেরিয়ে এসেছে, তাতে যোগাযোগের প্রধান তিন মাধ্যম নৌপথ, সড়কপথ ও রেলপথের অভিভাবক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে চরম সমন্বয়হীনতা লক্ষ করা যাচ্ছে। এসব সেতু নির্মাণ করতে ন্যূনতম নিয়মকানুনও মানা হয়নি।

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) জরিপ অনুযায়ী, ৯৯ সেতুর মধ্যে ৮৫টির উচ্চতাই নির্ধারিত মানের চেয়ে কম। সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজ), স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) ও বাংলাদেশ রেলওয়ের মতো সরকারি প্রতিষ্ঠান একের পর এক কম উচ্চতার সেতু নির্মাণ করে চলেছে। তাতে দেশের নৌপথগুলো চালু রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে পানি বেড়ে গেলে নৌযানগুলো বন্ধ হয়ে যায়।

সাশ্রয়ী ও পরিবেশের জন্য কম ক্ষতিকর যোগাযোগমাধ্যম হিসেবে গণ্য করা হয় নৌপথকে। নদীমাতৃক বাংলাদেশে একসময় নৌপথই ছিল যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম। পরে সড়ক ও রেলপথের প্রসার ঘটে। ১৯৬৫ সালে নৌপথ রক্ষায় সেতুর উচ্চতা নির্ধারণে উদ্যোগ নেওয়া হলেও অদ্যাবধি তা কার্যকর হয়নি। বিআইডব্লিউটিএ বলছে, নৌপথে তখন ‘স্ট্যান্ডার্ড হাই ওয়াটার লেভেল’ বা পানির উপরিভাগের সর্বোচ্চ স্তর থেকে সেতুর নিচের কাঠামো পর্যন্ত ব্যবধান ঠিক করার কাজ শুরু হয়। যদিও এ-সংক্রান্ত কোনো বিধিমালা হয়নি। ২০১০ সালে এ-সংক্রান্ত একটি বিধিমালা হয় এবং তা প্রজ্ঞাপন আকারে জারি হয়। বিধিমালায় নৌপথের শ্রেণি ধরে সেতু নির্মাণের উচ্চতা ও দৈর্ঘ্য বলা হলেও পথের নাম উল্লেখ করা হয়নি। পরে ২০১৮ সালে গুরুত্বপূর্ণ ৯৫টি নৌপথের নাম উল্লেখ করে আবার প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।

বিআইডব্লিউটিএর তথ্য অনুযায়ী, কম উচ্চতার সেতু নির্মাণ করেছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ), স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি), বাংলাদেশ রেলওয়ে। এসব সংস্থার দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা সেতু নির্মাণের নিয়মকানুন জানেন না তা নয়। অনেক সময় বিআইডব্লিউটিএর ছাড়পত্র নেওয়ারও প্রয়োজন বোধ করেন না। আবার বিষয়টি তদারক করতে যে লোকবল থাকার কথা, তা–ও বিআইডব্লিউটিএর নেই। ফলে সেতু নির্মাণের নামে এ ধরনের নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা চলছে।

পরিবহনবিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক সামছুল হক বিষয়টিকে সমন্বয়হীনতা বলে অভিহিত করেছেন। কেবল সমন্বয়হীনতা নয়, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দায়িত্বহীনতাও আছে। সংশ্লিষ্ট সংস্থার অনেক কর্মকর্তা নিজেদের খেয়ালখুশিমতো কাজ করেন।

টেকসই উন্নয়নে সারা বিশ্বেই গুরুত্ব পায় নৌপথ। কিন্তু বিস্ময়কর হলো সড়ক যোগাযোগের উন্নয়নের নামে নদীপ্রধান বাংলাদেশে সেই নৌপথকেই মুমূর্ষু করে রেখেছি। সরকারের মন্ত্রীরা যে ঢাকঢোল পিটিয়ে ঢাকার চারপাশের নদীগুলোতে নৌযান চালানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন, পরে দেখা গেল কোনো কোনো সেতু এত কম উচ্চতায় করা হয়েছে, যার নিচ নিয়ে বর্ষার সময় নৌযান চলতে পারে না।

অদৃশ্য ভূত এসব সেতু নির্মাণ করেনি। যাঁরা করেছেন, তাঁরা সরকারের দায়িত্বশীল পদেই আছেন বা ছিলেন। ৮৫টি কম উচ্চতার সেতু নির্মাণের বিষয়ে তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। যাঁরা নিয়মবহির্ভূতভাবে এসব করেছেন, তাঁদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। প্রয়োজনে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হোক। যে যত বড় পদে থাকুন না কেন, সড়কপথ উন্নয়নের নামে নৌপথ অচল করে রাখার এখতিয়ার কারও নেই।