আজ ১ বৈশাখ, বাংলা নতুন বছরের প্রথম দিন।
বৈশাখকে বরণ করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ।/ তাপসনিশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে,/ বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক।’ অতীতের গ্লানি-দুঃখ-জরা মুছে ফেলে নতুন বছর সবার জন্য আনন্দ ও মঙ্গলের বার্তা নিয়ে আসবে—এটাই প্রত্যাশিত।
বাংলা নববর্ষ বাঙালির জাতীয় উৎসব, প্রাণের উৎসব। প্রতিবছরের মতো এবারও বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষ বাংলা নববর্ষকে বরণ করতে অধীর অপেক্ষায় আছে। মেলা, উৎসব, শোভাযাত্রা, সংগীতানুষ্ঠানসহ নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে ১ বৈশাখ উদ্যাপন করার সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
সব মাধ্যমিক স্কুল ও কলেজে জাতীয় সংগীত ও ‘এসো হে বৈশাখ’ গান পরিবেশন ও শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে বাংলা নববর্ষ উদ্যাপনের নির্দেশ দিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। ইউনেসকোর ‘ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ অব হিউমিনিটি’-এর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে মঙ্গল শোভাযাত্রা। এটি আমাদের সবার জন্যই আনন্দের খবর।
পাকিস্তান আমলে বৈরী পরিবেশে ছায়ানট রমনার বটমূলে ঐতিহ্যবাহী সংগীতানুষ্ঠানের মাধ্যমে বর্ষবরণ শুরু করে। সেই ধারা এখনো চলছে। কেবল রমনার বটমূল নয়, সারা দেশেই এ ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়ে থাকে। এবার যখন নববর্ষকে বরণ করার জন্য জাতি প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখনই মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত বিতর্ক তৈরির চেষ্টা করেছেন কেউ কেউ, যা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য।
আমরা স্মরণ করতে পারি, সম্রাট আকবরের সময় খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য বাংলা নববর্ষ চালু হয়। এর পর থেকে নববর্ষকে কেন্দ্র করে ব্যবসায়ীরা সারা বছরের হিসাব-নিকাশ করে থাকেন, হালখাতা খোলেন। ক্রেতারা বকেয়া শোধ করেন। শত শত বছর ধরে এ ধারা চলে আসছে। আশার কথা, বাংলা নববর্ষকে কেন্দ্র করে বৈশাখী অর্থনীতি বেশ চাঙা হয়ে উঠেছে। নববর্ষের কয়েক দিন পরই মুসলমান সম্প্রদায়ের পবিত্র ঈদুল ফিতর। ফলে এবার কেনাকাটা আরও বাড়বে আশা করা যায়।
উল্লেখ্য, ২০০১ সালের ১ বৈশাখ রমনা বটমূলে বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে বোমা হামলা চালিয়ে ৯ জন মানুষকে হত্যা করে জঙ্গিরা। এ ছাড়া যশোরে উদীচীর সম্মেলনে বোমা হামলাসহ আরও অনেক নাশকতার ঘটনা ঘটায় এই অপশক্তি। পুলিশের মহাপরিদর্শক আবদুল্লাহ আল–মামুন গতকাল বলেছেন, এবার নববর্ষ সামনে রেখে আতঙ্কের পরিবেশ নেই। জননিরাপত্তায় পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
জনগণের নিরাপত্তা রক্ষায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু নিরাপত্তার নামে অহেতুক বিধিনিষেধ আরোপ কোনোভাবে কাম্য নয়। কেননা এ অবস্থায় জনমনে আতঙ্ক তৈরি হয়। উৎসব গরিমা হারায়।
বাংলা নববর্ষ বাঙালির সর্বজনীন উৎসব। ধর্ম-বর্ণ-গোত্রনির্বিশেষে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ এতে অংশ নিয়ে থাকে। এটি আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাঙালির আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে বাংলা নববর্ষেরও একটি উজ্জ্বল ভূমিকা আছে।
সমতলে বাঙালিরা যখন নববর্ষ উদ্যাপন করে, তখন পার্বত্য চট্টগ্রামে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর তিনটি সম্প্রদায়ও নতুন বছরের শুরুর উৎসব বৈসাবি উদ্যাপন করে থাকে; যা ত্রিপুরাদের কাছে বৈসুব, বৈসু বা বাইসু, মারমাদের কাছে সাংগ্রাই এবং চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যাদের কাছে বিজু নামে পরিচিত। এটাও তাদের বর্ষবরণ।
তাই বাংলা নববর্ষের পাশাপাশি আমরা বৈসাবি উৎসবকেও স্বাগত জানাই। নতুন বছর সবার কল্যাণ ও মঙ্গল বয়ে আনুক। কেবল আনুষ্ঠানিকতা নয়, আমাদের চিন্তাচেতনা, মনন ও প্রাত্যহিক জীবনেও বাংলা নববর্ষ প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠুক। স্বাগত ১৪৩০।