সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

এটি গুরুতর সংকট, সমাধানসূত্র জরুরি

আত্মহত্যা পাপ কি না, সেই তর্কে না গিয়েও যে তর্কাতীত সিদ্ধান্ত দেওয়া যায়, তা হলো নিজেকে হনন করার অধিকার কোনো ধর্ম–দর্শন দেয় না, দেশের বিদ্যমান আইনেও তা অপরাধ। সচরাচর নির্জলা স্বেচ্ছায় কেউ এ অপরাধ করে না। অন্য অনেক অপরাধের মতো এ ক্ষেত্রেও পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি তাকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেয়। সে কারণে এটিকে ‘অপরাধ’ পর্যায়ে ফেলা যায় কি না, তা-ও ক্ষেত্রবিশেষে তর্কসাপেক্ষ হয়ে ওঠে।

অপেক্ষাকৃত কম বয়সীদের, বিশেষত কিশোর-তরুণ বয়সীদের মানসিক চাপ সহ্য করার মতো মনের জোর কম থাকে। পরীক্ষার ফল বিপর্যয় কিংবা বন্ধু-বান্ধবীর সঙ্গে দ্বন্দ্বের জের ধরে সৃষ্ট মানসিক সংকটের সময় তাদের পাশে না দাঁড়িয়ে মা–বাবা, অভিভাবক কিংবা শিক্ষকেরা যদি উল্টো সেই চাপকে ত্বরান্বিত করেন, তাহলে তাদের অনেকে সংকটের চটজলদি সমাধান হিসেবে মৃত্যুকেই একমাত্র পথ মনে করে।

তীব্র অভিমানে তারা শেষ পর্যন্ত নিজের জীবন শেষ করে দিলে সেই মৃত্যুকে আত্মহত্যা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিষ্ঠিত চল অভিভাবকদের যাবতীয় দায় থেকে মুক্তি দেয়। সমাজস্বীকৃত ‘আত্মহত্যা’টি যে অনেক ক্ষেত্রে কার্যত ‘আত্মজহত্যা’ হয়ে দাঁড়ায়, তা উপলব্ধি করার মতো বিবেচনাবোধ মা-বাবা ও অভিভাবকদের নিষ্ফল বিলাপ ও সমাজের ‘আহা-উঁহু’সর্বস্ব নিরর্থক দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে মিলিয়ে যায়। ফলে একের পর এক বিয়োগান্ত ঘটনা ঘটতেই থাকে।

১০ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস সামনে রেখে ৯ সেপ্টেম্বর বেসরকারি সংস্থা আঁচল ফাউন্ডেশন আত্মহত্যার যে তথ্য উপস্থাপন করেছে, তা এককথায় ভীতিজাগানিয়া। তারা জানিয়েছে, এ বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত, অর্থাৎ আট মাসে গণমাধ্যমে ৩৬৪ জন শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার খবর প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে ১৯৪ জন স্কুলশিক্ষার্থী।

অর্থাৎ এ সময়ের মধ্যে গড়ে ৪৫ জনের বেশি শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। আর সেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৫৩ শতাংশই স্কুলের শিক্ষার্থী। এই শিক্ষার্থীদের প্রায় ৭৯ শতাংশের বয়স ১৩ থেকে ২০ বছর। ২০২০ সালের জুন থেকে ২০২১ সালের জুলাই পর্যন্ত ১৩ মাসে গণমাধ্যমে ১৫১ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার খবর প্রকাশিত হয়েছিল। এ বছরের আট মাসে তা দ্বিগুণের বেশি।

গবেষণাপ্রতিষ্ঠানটি বলছে, আত্মহত্যার কারণের মধ্যে রয়েছে পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া, পড়াশোনার চাপ, সেশনজট, অভিমান, প্রেমঘটিত বিষয়, পরিবার থেকে কিছু চেয়ে না পাওয়া, ইত্যাদি।

এ কারণগুলো গত বছরও বিদ্যমান ছিল। তাই সাধারণভাবে বলা যায়, এ বছর এমন কিছু ঘটেছে যা অদৃশ্যমান, কিন্তু শিশু–কিশোরদের আত্মহত্যাকে বাড়িয়ে দিয়েছে।

অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় এ বছর শিশু-কিশোরদের মনস্তত্ত্ব কিংবা তাদের পারিপার্শ্বিক সমাজবাস্তবতায় এমন কোনো পরিবর্তন এসেছে, যা এই সর্বগ্রাসী আত্মহননপ্রবণতাকে আতঙ্কজনক মাত্রায় নিয়ে এসেছে। কী সেই কারণ, তা সুনির্দিষ্ট করে কেউ কিছু বলেননি। তবে সাধারণভাবে ধারণা করা হচ্ছে, করোনাকালের অভিঘাত এ মাত্রাকে বাড়িয়ে দেওয়ার নেপথ্যে অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বহুতল ইমারত ও দালানকোঠার আধিক্য এবং খেলার মাঠের বিলীয়মান প্রবণতা শিশুদের আর বড়দের জগতের মধ্যে স্থানগত নৈকট্য বাড়ালেও ইন্টারনেটসহ তথ্যপ্রযুক্তির বহু পরিষেবা দুই প্রজন্মের মানসিক দূরত্বকে প্রসারিত করেছে।

বিশেষত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সন্তানের মনোজগৎকে কতটা প্রভাবিত করছে, সে বিষয়টি অনেক অভিভাবকেরই ধারণার অতীত। এ কারণে শিশু-কিশোরদের সঙ্গে অভিভাবকদের আচরণ কী হওয়া দরকার, সে বিষয়ে জনসচেতনতামূলক প্রচারণা দরকার।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মানসিক স্বাস্থ্যের বিকাশে কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা ও এর জন্য অবকাঠামো দরকার। এর পাশাপাশি আর কী কী করণীয়, তা নিয়ে বিশদ গবেষণা এবং সে অনুযায়ী এ সংকটের সমাধানের উদ্যোগ জরুরি।