কোটা সংস্কারে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ও পরবর্তী সংঘর্ষ–সহিংস পরিস্থিতিতে গত বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই ২০২৪) রাত থেকে দেশজুড়ে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। মঙ্গলবার (২৩ জুলাই ২০২৪) রাত থেকে সীমিত আকারে ইন্টারনেট চালু করা হয়। ফলে শনিবার (২০ জুলাই ২০২৪) প্রথম আলোর ছাপা পত্রিকায় প্রকাশিত এ সম্পাদকীয় এখন অনলাইনে প্রকাশ করা হলো।
কয়েক দিন ধরে দেশে যে হত্যাকাণ্ড ও সহিংসতা ঘটছে, তাতে আমরা ব্যথিত ও মর্মাহত। আরও বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সরকারের তরফ থেকে কার্যকর কোনো উদ্যোগ লক্ষ করা যাচ্ছে না। শান্তি ও সমঝোতার একটি পরিবেশ তৈরির উদ্যোগ যেখানে জরুরি, সেখানে সরকারের কঠোর অবস্থানই দৃশ্যমান, যা পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করেছে। গতকালও প্রাণ গেছে অন্তত ৫৬ জনের (রাত ১১টা পর্যন্ত পাওয়া খবর)।
এটা চরম দুঃখ ও বেদনার যে কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে সহিংসতায় তিন দিনে (মঙ্গল, বৃহস্পতি ও শুক্র) ১০৩টি প্রাণ ঝরে গেছে।
৫ জুন হাইকোর্টের একটি রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষার্থীরা কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। সে সময় সরকার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে পরিস্থিতি এতটা নাজুক হতো না। এতগুলো মানুষকে জীবন দিতে হতো না। আমরা শুরু থেকে এ ব্যাপারে জোর দিয়ে আসছি।
শিক্ষার্থীদের সংস্কার দাবির সঙ্গে সরকার যে একমত, সে কথা সরকারের মন্ত্রীরাও বলেছেন। তারপরও কেন সরকার এ ব্যাপারে কোনো সুনির্দিষ্ট বক্তব্য বা প্রতিশ্রুতি না দিয়ে আদালতের দোহাই দিয়ে সময়ক্ষেপণ করল, তা বোধগম্য নয়। শুধু তা-ই নয়, শান্তিপূর্ণ আন্দোলনটি দমনে সরকার-সমর্থক ছাত্রসংগঠনটিকে মাঠে নামিয়ে পরিস্থিতিকে এই পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সহিংসতা শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক না থেকে এখন দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে।
পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিতে শুরু করলে সরকার যে উদ্যোগগুলো নেওয়া শুরু করে, তার মধ্যে রয়েছে সংবাদ সম্মেলন করে আইনমন্ত্রীর আলোচনার প্রস্তাব, মেধার ভিত্তিতে ৮০ ভাগ নিয়োগের প্রস্তাব এবং চেম্বার জজ আদালতে আবেদন করে কোটাসংক্রান্ত শুনানির তারিখ ২১ জুলাইয়ে এগিয়ে আনা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, সরকারের এই উদ্যোগগুলো পরিস্থিতি সামাল দিতে পারেনি।
কয়েক দিন ধরে দেশে যে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তাতে স্বাভাবিক জনজীবন চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। বাস-ট্রেনসহ সব ধরনের গণপরিবহন বন্ধ। অগ্নিসংযোগসহ ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের কারণে দেশজুড়ে একধরনের অচলাবস্থা চলায় অর্থনীতির চাকাও স্থবির হয়ে পড়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ঢাকায় আসতে পারছে না। ঊর্ধ্বমুখী বাজার সীমিত আয়ের মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। ব্যাহত হচ্ছে পণ্য সরবরাহ।
এই পরিস্থিতি অব্যাহতভাবে চলতে পারে না। ইতিমধ্যে অনেক দেরি হয়ে গেছে। সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করে, রাজপথে নিজেদের কর্মী-সমর্থকদের নামিয়ে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে আন্দোলন দমনের যে নীতি সরকার নিয়েছে, তা যে ফল দেয়নি, তার প্রমাণ অব্যাহত সহিংসতা ও মৃত্যু। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহের সুযোগ নেই যে কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রতি দেশবাসীর নৈতিক সমর্থন রয়েছে। তা ছাড়া শিক্ষার্থীসহ এতগুলো মৃত্যুতে জনগণ একই সঙ্গে মর্মাহত ও ক্ষুব্ধ। সরকার ও এর নীতিনির্ধারকদের সংকটের গভীরতা ও বাস্তবতা বিবেচনায় নিতে হবে।
আমরা মনে করি, শিক্ষার্থীরা আলোচনার জন্য যেসব শর্তের কথা বলেছেন, তা অযৌক্তিক নয়। আলোচনায় বসার আগে তাঁদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে হবে। নিহত ব্যক্তিদের পরিবারগুলোকে ক্ষতিপূরণের ঘোষণা ও আহত ব্যক্তিদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করার সর্বাত্মক উদ্যোগ নিতে হবে। এতগুলো মৃত্যুর পর যেকোনো আলোচনার শুরুর জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে পরিবেশ তৈরি করা। এ জন্য প্রথমেই প্রয়োজন কঠোর বলপ্রয়োগের পথ থেকে সরে আসা। আমরা আবারও প্রত্যাশা করছি, আরও ক্ষতি হওয়ার আগেই সরকার শুভবুদ্ধির পরিচয় দেবে।