গার্ডারচাপায় ৫ জনের মৃত্যু

এটা দুর্ঘটনা নয়, হত্যাকাণ্ড

রাজধানীর উত্তরায় বাস র‍্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পে গার্ডারের চাপায় প্রাইভেট কার আরোহী হতাহতের ঘটনাটিকে কোনো অর্থেই দুর্ঘটনা বলার সুযোগ নেই। বিশৃঙ্খলা, অবহেলা ও গাফিলতির চূড়ান্ত প্রদর্শন হিসেবে ঝরে গেল দুই শিশুসহ পাঁচটি প্রাণ। এ ঘটনায় দেশজুড়ে সমালোচনার ঝড় বয়ে চলেছে। সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে প্রকল্পের কাজ।

প্রথম আলোর প্রতিবেদন জানাচ্ছে, রাজধানীর হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গাজীপুরের জয়দেবপুর পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার পথে বিশেষ লেনের মাধ্যমে বাস চলাচলের জন্য এক দশক আগে শুরু হয় বিআরটি প্রকল্প। ধীরগতি ও অব্যবস্থাপনার কারণে এ প্রকল্প নিয়ে বারবার প্রশ্ন উঠেছে।

২০১৬ সালের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এ বছরের জুন মাস পর্যন্ত মাত্র প্রকল্পের ৭৮ শতাংশ অগ্রগতি ঘটেছে। সময় বৃদ্ধির সঙ্গে ব্যয়ও বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে।

প্রচলিত আইন অনুযায়ী, বিদ্যমান সড়কের ওপর নির্মাণকাজের সময় যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক রাখার দায়িত্ব প্রকল্প কর্তৃপক্ষের। এ জন্য খানাখন্দ মেরামত করতে হয় নিয়মিত। চলাচলকারী যানবাহন ও মানুষের নিরাপত্তা বিধান করাও প্রকল্পের কাজের অংশ। এ জন্য নির্মাণ এলাকা ঘিরে রাখার নিয়ম। গত পরশুর দুর্ঘটনার সময়ের সিসিটিভি ফুটেজ থেকে দেখা যাচ্ছে, মহাসড়কে যখন যান চলাচল করছে, সে সময়েই ক্রেন দিয়ে প্রায় ৭০ টন ওজনের গার্ডারটি ওঠানো হচ্ছে। ক্রেন কাত হয়ে ভারসাম্য হারালে গার্ডারটি প্রাইভেট কারের ওপর গিয়ে পড়ে। এ সময় কোনো ধরনের নিরাপত্তাবেষ্টনী কিংবা প্রতিবন্ধকতা দেওয়া হয়নি।

একই ধরনের অবহেলা ও দায়িত্বহীনতার কারণে বিআরটি প্রকল্পে বারবার দুর্ঘটনা ঘটছে। নির্মাণকাজ শুরুর পর এ পর্যন্ত চারটি বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেছে। গত বছর ১৪ মার্চ বিমানবন্দর ও আবদুল্লাপুরে একই দিনে দুবার গার্ডারধসের ঘটনা ঘটে। এতে তিনজন চীনের নাগরিকসহ নির্মাণকাজে সঙ্গে যুক্ত ছয় শ্রমিক আহত হন। ডেইলি স্টার-এর প্রতিবেদন জানাচ্ছে, ওই দুর্ঘটনার পর গঠিত তদন্ত কমিটি নির্মাণ প্রকল্পে নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনার ত্রুটি খুঁজে পায়। তদন্ত কমিটির সুপারিশের কোনোটাই বাস্তবায়িত হয়নি।

চারটি ভাগে ভাগ করে বিআরটি প্রকল্পটি চলছে। এর মধ্যে উড়ালপথ ও সড়ক নির্মাণের কাজ করছে তিনটি চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু এ কাজে তাদের সক্ষমতা আছে কি না, সেই প্রশ্ন বারবার উঠেছে। নির্মাণকাজের খোঁড়াখুঁড়ির জন্য কারণে এ মহাসড়কে চলাচল করা ব্যক্তিদের সীমাহীন ভোগান্তি শাস্তির পর্যায়ে পৌঁছেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি বড় প্রকল্প নেওয়ার আগে প্রাথমিক সমীক্ষা ও চূড়ান্ত সমীক্ষার পরই কেবল কাজ শুরু হতে পারে। কিন্তু প্রাথমিক সমীক্ষা করার পর চূড়ান্ত সমীক্ষা ও নকশা প্রণয়নের আগেই বিআরটির কাজ শুরু হয়। ফলে গোড়ায় গলদ রেখে শুরু হওয়া এ প্রকল্পের ফলে সৃষ্ট অবর্ণনীয় জনদুর্ভোগ ও দুর্ঘটনা নিয়মিত বিষয় হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে এ প্রকল্পে অর্থায়ন করেছে এডিবি, এএফডির মতো আন্তর্জাতিক সংস্থা। এ ধরনের প্রকল্প ঠিকমতো বাস্তবায়িত হচ্ছে কি না, তা তদারকির দায়িত্ব তাদেরও রয়েছে।

যে বিবেচনায় করা হোক না কেন, বিআরটি অভিভাবকহীন একটি প্রকল্প। এ সুযোগেই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে যেভাবে ইচ্ছে সেভাবে কাজ করছে। মানুষের জানমালের নিরাপত্তাকেও গ্রাহ্য করছে না। প্রাথমিক তদন্তে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান গেজহুবা গ্রুপের দায় পাওয়া গেছে।

কিন্তু বস্তুতপক্ষে, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়, বিআরটি কর্তৃপক্ষ, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের চরম অবহেলা ও দায়িত্বহীনতার কারণেই পাঁচজন মানুষ অকালে প্রাণ হারিয়েছেন। এটা কোনোভাবেই দুর্ঘটনা নয়, বরং কাঠামোগত হত্যাকাণ্ডের দৃষ্টান্ত। নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি করে দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিন।