সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও নজরদারি প্রয়োজন

একের পর এক দুর্ঘটনা জানান দেয় সড়কে কী ভয়াবহ নৈরাজ্য চলছে। প্রতিটি দুর্ঘটনায় কিছু মানুষ মারা যায়, কিছু মানুষ আহত হয়ে যন্ত্রণা ভোগ করে, ভুক্তভোগী পরিবারগুলো আহাজারি করতে থাকে, কিন্তু কর্তৃপক্ষের ঘুম ভাঙে না। দুর্ঘটনার পর পরিবহনমালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলো থেকে দায় এড়ানোর চেষ্টা চলে। কর্তৃপক্ষ নানা অজুহাত দেখাতে থাকে। কিন্তু পরিস্থিতি বদলায় না।

২২ মার্চ প্রথম আলোয় ‘সড়ক মন্ত্রণালয় পারছে না’ শিরোনামে খবর বের হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে দুই সচিব ও বিআরটিএ ও বিআরটিসির চেয়ারম্যান সংবাদ সম্মেলন করে আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টা করেছেন। তাঁরা বলেন, প্রতিবেদনে প্রকাশিত তথ্য সর্বাংশে সত্য নয়।

কিন্তু কোথায় কোথায় ভুল আছে, তা তাঁরা বলেননি। প্রথম আলোর প্রতিবেদনেও বলা হয়নি যে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের কোনো সাফল্য নেই। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেলসহ বহু প্রকল্প তারা বাস্তবায়ন করেছে, এখনো অনেক প্রকল্প চলমান। এসব নিয়ে প্রথম আলো প্রশ্ন তোলেনি। প্রশ্ন তুলেছে সড়কে বিশৃঙ্খল অবস্থা ও দুর্ঘটনার সংখ্যা এবং প্রাণহানির সংখ্যা বাড়ানো নিয়ে।

সড়ক পরিবহন ও সেতু বিভাগের দুই সচিব বলেন, পথচারীদের অসচেতনতা ও অপরিপক্ব মোটরসাইকেলচালকদের জন্যই বেশি দুর্ঘটনা ঘটছে। এটি সড়কে প্রাণহানি ও দুর্ঘটনার জন্য একমাত্র কারণ নয়। সড়ক মন্ত্রণালয় সড়ক উন্নত ও ত্রুটিমুক্ত করতে কাজ করছে, সেটাও আমরা অস্বীকার করছি না।

কিন্তু সড়কে ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলা কিংবা লাইসেন্স ছাড়া চালকেরা কীভাবে গাড়ি চালাচ্ছেন, সেই প্রশ্ন তো আমাদের করতেই হবে। যানবাহন পরীক্ষার ক্ষেত্রে তাঁরা লোকবল কম থাকার কথা বলেন। কিন্তু সেই কারণে তো সড়কে মৃত্যুর মিছিল চলতে পারে না। একজন চালক কত ঘণ্টা একটানা গাড়ি চালাতে পারবেন, সে ব্যাপারে খোদ প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনাও পালিত না হওয়ার দায় যাত্রী, পথচারী কিংবা সাধারণ মানুষের ওপর চাপালে হবে না।

সম্প্রতি ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের কুতুবপুর এলাকায় ইমাদ পরিবহনের যে বাসটি দুর্ঘটনার কবলে পড়ে ১৯ জন মানুষ মারা যান, সেই বাসের চালক ঘুমঘুমচোখে গাড়ি চালাচ্ছিলেন। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ৩০ ঘণ্টার বেশি বাস চালাতে গিয়ে চালক অতিশয় ক্লান্ত ছিলেন। গত জানুয়ারিতে বরিশাল থেকে আসা যে অ্যাম্বুলেন্সটি একই এক্সপ্রেসওয়েতে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে ছয়জন মারা গেলেন, সেটির চালক একটানা ১৮ ঘণ্টা স্টিয়ারিংয়ে বসা ছিলেন। এসব ক্ষেত্রে বিআরটিএ ও সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের যতটা তদারকি থাকা দরকার, তার মারাত্মক ঘাটতি দেশবাসীকে উদ্বিগ্ন না করে পারে না।

প্রথম আলোর প্রতিবেদনের লক্ষ্য সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়কে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করানো নয়। সড়ক পরিবহন আইন প্রতিপালন ও সড়কে শৃঙ্খলা আনার ক্ষেত্রে যেসব দুর্বলতা ও ঘাটতি আছে, তা দূর করাই এর উদ্দেশ্য। সড়ক পরিবহন আইন নিয়ে একশ্রেণির পরিবহনমালিক ও শ্রমিকনেতা শোরগোল তুলেছিলেন। তাঁরা ভেবে দেখেন না সড়কে বিশৃঙ্খলা থাকলে যাত্রী ও পথচারীদের পাশাপাশি গাড়ির চালক-কর্মীরাও মারা যান।

আমরা মনে করি, সড়ক পরিবহনকে নিরাপদ করতে হলে ২০১৮ সালের সড়ক পরিবহন আইন বাস্তবায়নের পাশাপাশি এ খাতে যে মাফিয়া চক্র জেঁকে বসেছে, তাদেরও সমূলে উৎপাটন করতে হবে। এই চক্র যে কেবল যাত্রীদের জিম্মি করেছে তাই নয়, তারা সাধারণ পরিবহনশ্রমিকদেরও মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে। সড়কে শৃঙ্খলা ফিরে এলে যাত্রী, পরিহনমালিক ও শ্রমিক—সবাই নিরাপদে থাকবেন। এ বিষয়ে আইনের যথাযথ প্রয়োগ, আইন ভঙ্গকারী ব্যক্তিদের উপযুক্ত শাস্তি ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরদারি বাড়ানোর বিকল্প নেই।