সরকার ডিলার ও কৃষক পর্যায়ে ইউরিয়া, ডিএপি, টিএসপি ও এমওপি সারের দাম কেজিতে পাঁচ টাকা বাড়িয়েছে। ১০ এপ্রিল কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে সারের দাম বাড়ানোর আদেশে বলা হয়, চলমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক বাজারে সারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে সারের আমদানি যৌক্তিক পর্যায়ে রাখা এবং সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে সারের বিক্রয়মূল্য পুনর্নির্ধারণ করা হলো।
সরকার এমন সময়ে দাম বাড়ানোর ঘোষণা দিল, যখন আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম কমে আসছে। বিশ্বব্যাংকের চলতি মাসে হালনাগাদকৃত পিংক শিটের (আন্তর্জাতিক বাজারসংক্রান্ত নিয়মিত প্রতিবেদন) তথ্য অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক বাজারে গত এক বছরে ইউরিয়া সারের দাম কমেছে প্রায় ৬২ শতাংশ। একই সময়ে ডিএপির মূল্যহ্রাস হয়েছে প্রায় ২৪ শতাংশ। টিএসপি ও এমওপির দাম কমেছে যথাক্রমে প্রায় ২৫ ও ৪৭ শতাংশ।
দাম বাড়ায় এখন থেকে কৃষক পর্যায়ে প্রতি কেজি ইউরিয়া ও টিএসপির দাম ২২ থেকে ২৭ টাকা, ডিএপি ১৬ টাকা থেকে বেড়ে ২১ টাকা, এমওপি সারের দাম ১৫ থেকে ২০ টাকা হয়েছে। অন্যদিকে ৫ টাকা বেড়ে ডিলার পর্যায়ে প্রতি কেজি ইউরিয়া ও টিএসপির দাম ২৫ টাকা, ডিএপির দাম ১৯ টাকা এবং প্রতি কেজি এমওপির দাম ১৮ টাকা হয়েছে, যা আগে ছিল ইউরিয়া ও টিএসপি ২০ টাকা, ডিএপি ১৪ টাকা এবং এমওপি ১৩ টাকা। দাম বৃদ্ধির হার ১৫ থেকে ২০ শতাংশ।
৩ এপ্রিল কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেছিলেন, ‘এ বছর সারের দাম বাড়ানোর কোনো পরিকল্পনা নেই।’ এর এক সপ্তাহ পর দাম বাড়ানোর এ ঘোষণাকে তাই স্বাভাবিক বিবেচনা করার সুযোগ নেই। যখন আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেশি ছিল, সে সময় সরকার দাম বাড়ায়নি। যখন আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমে আসছে, তখন দাম বাড়ানোকে আমরা সরকারের উল্টো যাত্রা হিসেবে দেখছি। অনেকের মতে, আইএমএফএর শর্ত পূরণ করতে গিয়েই ভর্তুকি তুলে দিতে সরকার সারের দাম বাড়িয়েছে। এর আগে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দামও কয়েক দফা বাড়ানো হয়েছে। প্রশ্ন হলো রাজস্ব ও আর্থিক খাতে সংস্কার না করে কৃষক ও সাধারণ জনগণের জন্য দেওয়া ভর্তুকি তুলে নেওয়ার সহজ পথ কেন বেছে নেওয়া হচ্ছে? সরকারকে মনে রাখতে হবে, সারের দাম বাড়লে কৃষকেরাই কেবল ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না, কৃষিতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতিতে চলমান বৈশ্বিক সংকটে যখন কৃষি দেশের অর্থনীতি চাঙা রেখেছে, জনগণের খাদ্যের চাহিদা মিটিয়েছে, তখন সারের দাম বাড়ানোর যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরাও। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক গবেষণা পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ এম আসাদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই মূল্যবৃদ্ধির কারণে কৃষিপণ্যের উৎপাদন ব্যয়ও যে বাড়ছে, সেটা আমাদের বিবেচনায় কম থাকছে।’
এর আগে জ্বালানি তেল ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোয় কৃষকের সেচ খরচও বেড়েছে। বেড়েছে কৃষি উৎপাদনের অন্যান্য উপকরণের দামও। গত বছর অনেক কৃষক প্রয়োজনের তুলনায় কম সার দিয়েছেন বলে গণমাধ্যমে খবর এসেছে। দাম বেড়ে যাওয়ায় এবার তঁারা আরও কম সার ব্যবহার করবেন। কম সার ব্যবহার করলে ফসলের উৎপাদনও কমে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। এ অবস্থায় সারের ভর্তুকি না কমিয়ে সরকার অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় কমিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে পারত। তা না করে কৃষকের ঘাড়ে কেন এ বাড়তি বোঝা চাপানো হলো?
কৃষিপণ্যের উৎপাদন ব্যয় সহনীয় পর্যায়ে রাখা গেলে কেবল কৃষকই লাভবান হবেন না; ভোক্তা সাধারণও এর সুফল পাবেন। অতএব সারের দাম বাড়ানোর বিষয়টি সরকারের পুনর্বিবেচনা করা উচিত।