গত মঙ্গলবার বিবিএস ‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২২’-এর বরাতে প্রথম আলো যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তা হতাশাজনক। এতে দেখা যায়, ২০২২ সালে ১ হাজার শিশু জন্ম নিলে তাদের মধ্যে ২৫টি শিশু মারা যায় বয়স এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগে। ২০২১ সালে এই সংখ্যা ছিল ২২। ২০২১ সালে পাঁচ বছর বয়সীদের মৃত্যুহার (প্রতি হাজারে জীবিত জন্মে) ছিল ২৮, ২০২২ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৩১। অর্থাৎ ১ হাজার শিশু জন্ম নিলে তাদের বয়স পাঁচ বছর হওয়ার আগেই ৩১টি শিশু মারা যাচ্ছে।
শিশুমৃত্যুর হার বাড়ার কারণ প্রধানত অপরিণত ও কম ওজনের শিশুর জন্ম নেওয়া, জন্মের সময় শ্বাসকষ্ট, সংক্রমণ, জন্মগত ত্রুটি, মা ও শিশুর অপুষ্টিতে ভোগা ও প্রসূতিকালের নানা জটিলতা। ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিশু বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান আবিদ হোসেন মোল্লার মতে, দেশে পাঁচ বছরের কম বয়সে শিশুমৃত্যুর মধ্যে প্রায় অর্ধেক মারা যায় জন্মের ২৮ দিনের মধ্যে, অর্থাৎ নবজাতক অবস্থায়।
বিবিএস বলছে, ২০১৮ সালে বাংলাদেশে শিশুমৃত্যুর হার ছিল ২৯। ২০১৯ সালে তা কমে হয় ২৮। পরের দুই বছর এই হার অপরিবর্তিত ছিল। ২০২২ সালে এসে দেখা গেল, তা বেড়েছে এবং চার বছর আগের হারের চেয়ে বেশি। দুই মাস আগে ২০২২ সালের বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপের ফলাফল প্রকাশ করেছিল জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান (নিপোর্ট) এবং আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি)। তাতেও বলা হয়, দেশে শিশুমৃত্যুর হার ৩১।
মায়ের দুধ না খাওয়ানোর সঙ্গেও শিশুমৃত্যুর সম্পর্ক রয়েছে। অতি ঝুঁকিপূর্ণ নবজাতক ও শিশুদের হাসপাতালে রেখে চিকিৎসার প্রয়োজন আছে। কিন্তু সব হাসপাতালে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও মিডওয়াইফ নেই। আবার এখনো অর্ধেকের মতো শিশু জন্ম নেয় বাড়িতে প্রশিক্ষিত মিডওয়াইফের সহায়তা ছাড়া। এ কারণে নানা জটিলতা দেখা দেয়, যা শিশুকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, সার্কভুক্ত তিনটি দেশের শিশুমৃত্যুর হার বাংলাদেশের চেয়ে কম। সবচেয়ে কম শ্রীলঙ্কায়— ১১। মালদ্বীপ ও ভুটানে এই হার যথাক্রমে ২০ ও ৩০। সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে শিশুমৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি পাকিস্তানে। দেশটিতে ১ হাজার শিশু জন্ম নিলে ৭৪টি শিশুর মৃত্যু হয় বয়স পাঁচ বছর হওয়ার আগেই।
বাংলাদেশে শিশুমৃত্যুর হার কমছে বলে নীতিনির্ধারকদের মধ্যে একধরনের আত্মসন্তুষ্টি লক্ষ করা যায়। কিন্তু ধারাবাহিক পরিসংখ্যান তা বলে না। শিশুমৃত্যুর হারে আমরা এক ধাপ সামনে এগোই তো দুই ধাপ পেছনে যাই। অগ্রগতিটা ধরে রাখতে হলে মায়ের গর্ভধারণ থেকে শুরু করে শিশুর জন্মের অন্তত ২৮ দিন পর্যন্ত নিবিড় পরিচর্যা প্রয়োজন। এর কোনো পর্যায়ে নজরদারির ঘাটতি কাম্য নয়।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিচালক (মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য কর্মসূচি) মো. মাহমুদুর রহমান ‘শিশুমৃত্যু বেড়েছে এমন কোনো রেকর্ড আমাদের কাছে নেই’ বলে দায়িত্ব এড়ানোর চেষ্টা করেছেন।
বিবিএসের তথ্য-উপাত্ত তাঁদের না পাওয়ার কথা নয়। তাঁরা যদি সমস্যা না দেখেন, সমাধান করবেন কীভাবে? বাংলাদেশ শিশুমৃত্যুর হার কমাতে এতটাই ‘সক্ষমতা’ দেখিয়েছে যে দক্ষিণ এশিয়ার শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ ও ভুটান তো বটেই, তিউনিসিয়া, মরক্কো ও আলজেরিয়ারও পেছনে আছি আমরা।
আশা করি, দেরিতে হলেও নীতিনির্ধারকেরা আত্মতুষ্টিতে না ভুগে শিশুমৃত্যুর হার কমানোয় দ্রুত কার্যকর ও টেকসই পদক্ষেপ নেবেন।