সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

জরিপে হতাশাজনক চিত্র

তরুণদের কথা শুনুন, কথা বলতে দিন

কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য লিখেছিলেন, ‘আঠারো বছর বয়স কী দুঃসহ/ স্পর্ধায় নেয় মাথা তোলবার ঝুঁকি/ আঠারো বছর বয়সেই অহরহ/ বিরাট দুঃসাহসেরা দেয় যে উঁকি।’ কিন্তু বাংলাদেশের আজকের তরুণেরা কি স্পর্ধায় মাথা তুলতে পারছেন? অন্যায়ের বিরুদ্ধে কি তাঁরা দুঃসাহস দেখাতে পারছেন?

নাগরিক প্ল্যাটফর্ম আয়োজিত যুবজরিপ বলছে, পারছেন না। জরিপে অংশগ্রহণকারী ৪৩ শতাংশ যুবক জানিয়েছেন, মতামত প্রকাশে তাঁরা দ্বিধা, অস্বস্তি, সংকোচ বোধ করেন। অন্যদিকে ৩৬ দশমিক ৪ শতাংশ মতামত প্রকাশ করতে গিয়ে অতীতে হেনস্তা, হয়রানির শিকার হয়েছেন।

নাগরিক প্ল্যাটফর্ম যুবকদের মতামত তুলে ধরতে গত সেপ্টেম্বর ও চলতি অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে অনলাইনে এ জরিপ করে। এতে ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী দেশের ৫ হাজার ৭৫ জন যুবক অংশগ্রহণ করেন। জরিপে তাঁদের কাছে ভোট ও রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, নীতি যুক্ততা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও প্রতিনিধিত্ব-সম্পর্কিত বর্তমান পরিস্থিতি জানতে চাওয়া হয়।

কেবল মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নয়, সমাজ, অর্থনীতি ও রাজনীতি বিষয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে তরুণদের যে মতামত উঠে এসেছে, তা খুবই হতাশাজনক। জনবিন্যাসে তরুণেরাই দেশের প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের গরিষ্ঠসংখ্যক। অথচ রাষ্ট্রের উন্নয়নদর্শন কিংবা গণতন্ত্র—কোনোটাই তরুণদের আকাঙ্ক্ষা ধারণ করতে পারছে না। তাঁদের আশাহীনতা ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বাইরে রেখে কোনো উন্নয়নই টেকসই হতে পারে না।

জরিপে অংশগ্রহণকারী ৬৯ দশমিক ৪ শতাংশ তরুণ দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতিতে উন্নয়নের প্রধান বাধা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এটা কেবল তরুণদের জরিপে উঠে আসেনি। বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি গবেষণায়ও দুর্নীতিকে উন্নয়নের প্রধান প্রতিবন্ধকতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

জরিপে সবচেয়ে উদ্বেগজনক তথ্যটি হলো, ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ যুবক বলেছেন, সুযোগ পেলে তঁারা স্থায়ীভাবে বিদেশে চলে যাবেন। এই তরুণদের বেশির ভাগই উচ্চশিক্ষিত। আমাদের রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকেরা কি কখনো জানতে চেয়েছেন, কেন তাঁরা দেশ ছাড়তে চাইছেন? জরিপের তথ্য অনুযায়ী, রাজনীতি ও ছাত্ররাজনীতিতে আগ্রহী মাত্র ১১ দশমিক ৬ শতাংশ যুব। অন্যদিকে রাজনীতি নিয়ে অনাগ্রহী যুবদের সংখ্যা আগ্রহী যুবদের চেয়ে তিন গুণ বেশি (৩৫ দশমিক ২ শতাংশ)। ৫৩ দশমিক ৮ শতাংশ যুবক জানিয়েছেন, তঁারা জাতীয় নির্বাচনে কখনো ভোট দেননি।

তরুণেরা ভোট দিতে না পারলে রাজনীতিতে আগ্রহ হারাবেন, সেটাই স্বাভাবিক। যে দেশে তিন দশকের বেশি সময় ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয় না, সেখানে ছাত্ররাজনীতির প্রতি সাধারণ শিক্ষার্থীদের আগ্রহ থাকারও কোনো কারণ নেই।

যে উন্নয়ন তরুণদের চাহিদা পূরণ করতে পারে না, সেই উন্নয়নের প্রতি তরুণেরা আস্থাও রাখতে পারেন না। যে আইন তরুণের কণ্ঠরোধ করে দেয়, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করে, সেই আইনকে তঁারা হৃষ্টচিত্তে মেনে নিতে পারেন না।

জেল-জুলুমের ভয় দেখিয়ে প্রবীণদের মুখ বন্ধ করা যায়, তরুণদের নয়। যেদিন নাগরিক প্ল্যাটফর্মে যুবজরিপ প্রকাশ করা হয়, সেদিনই শাহবাগে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার দাবিতে তরুণ শিল্পী, লেখক, কবিরা ভোটাধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার দাবিতে সমাবেশ করেছিলেন।

উন্নয়ন কখনোই গণতন্ত্রের প্রতিপক্ষ নয়। কিন্তু রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকেরা গণতন্ত্রকে উন্নয়নের প্রতিপক্ষ হিসেবেই দাঁড় করিয়েছেন। এমনকি তঁাদের উন্নয়ননীতিতে তরুণদের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন আছে, এমনটিও বলা যাবে না। ফলে তরুণদের একাংশ দেশ ত্যাগ করতে চাইছেন, আরেক অংশ রাজনীতির প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন করছেন। অবিলম্বে এই অবস্থার পরিবর্তন না হলে দেশ ও জাতির জন্য ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনতে পারে।

অতএব, তরুণদের কথা শুনুন, তাঁদের কথা বলতে দিন।