সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

ঢাকার নতুন দারিদ্র্য

উন্নয়ন টেকসই করতে বৈষম্য কমান

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক গবেষণায় রাজধানী ঢাকার দারিদ্র্য পরিস্থিতির যে চিত্র উঠে এসেছে, তাকে অতিশয় উদ্বেগজনক বললেও কম বলা হয়।

২ হাজার ৪৬টি খানা জরিপ করে বিআইডিএস বলেছে, ঢাকার বাসিন্দাদের ২২.৯০ শতাংশ দরিদ্র এবং মোট দরিদ্রের প্রায় ৫০ শতাংশ নতুন, অর্থাৎ আগে তাঁরা দারিদ্র্যসীমার ওপরে ছিলেন।

করোনা মহামারির পর বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠানগুলো যখন বিভিন্ন জরিপ দিয়ে দেখিয়েছিল দরিদ্র মানুষের সংখ্যা অনেক বেড়েছে, তখন সরকারের পক্ষ থেকে অস্বীকার করা হয়েছিল। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এসব জরিপের ভিত্তি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিলেন। এখন সরকারি প্রতিষ্ঠানের জরিপেই বিচলিত হওয়ার মতো চিত্র পাওয়া গেল।

বিআইডিএসের জরিপ অনুয়ায়ী, করোনার আগে, অর্থাৎ ২০১৯ সালে দরিদ্র খানার আয়ের ৩৩ দশমিক ৬০ শতাংশ এসেছে আত্মকর্মসংস্থান থেকে। গত বছর সেটি বেড়ে ৩৮ দশমিক ৫৬ শতাংশ হয়েছে। ২০১৯ সালে দরিদ্র খানা বা পরিবারের মধ্যে ৩৯ দশমিক ২৯ শতাংশ এমএফএস বা মোবাইলে আর্থিক সেবা ব্যবহার করত।

করোনার পর, অর্থাৎ ২০২২ সালে সেটি বেড়ে ৭৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ হয়েছে। করোনার আগে ৩২ দশমিক ২২ শতাংশ পরিবারের ব্যাংক হিসাব ছিল। পরে সেটি বেড়ে হয়েছে ৩৩ দশমিক ৭৯ শতাংশ। এর ইতি-নেতি দুটো দিকই আছে। এমএফএস ব্যবহারের ফলে আর্থিক লেনদেন সহজতর হলেও এর বিনিময়ে দরিদ্র মানুষকে যে পরিমাণ সার্ভিস চার্জ বা মাশুল দিতে হয়, সেটি তাঁদের ওপর বাড়তি বোঝা বলে মনে করি। মাশুল আরও কমানো প্রয়োজন।

পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বৈষম্য প্রশমনে সমতাভিত্তিক সুযোগের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। কিন্তু সমস্যা হলো যখন মুষ্টিমেয় মানুষ প্রায় সব সুবিধা হাতিয়ে নেন, তখন গরিষ্ঠসংখ্যক মানুষকে দারিদ্র্যের কশাঘাত সহ্য করতে হয়। সামাজিক নিরাপত্তাবলয় বাড়িয়ে বা ভাতা দিয়ে দারিদ্র্য দূর করা যায় না। দারিদ্র্য দূর করতে সম্পদ ও কর্মসংস্থান বাড়াতে হয়। সরকার সেই সুযোগ তৈরি করবে আশা করি।

এ জরিপেই এসেছে, দ্রব্যমূল্যের অব্যাহত ঊর্ধ্বগতিতে মানুষ সামাল দিতে না পেরে খাবার কম কিনছেন, নিম্নমানের খাবার কিনছেন কিংবা আবার শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা খাতের ব্যয় কমিয়ে দিচ্ছেন। অনেকে পুরোনো সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছেন। বিআইডিএসের মহাপরিচালক বিনায়ক সেন বলেছেন, করোনাকালে ঢাকার অনেক শিশু স্কুল থেকে ঝরে পড়েছে। নিম্ন আয়ের পরিবারের মধ্যে সেই প্রবণতা বেশি। শহরাঞ্চলে সামাজিক সুরক্ষাসুবিধা অল্প বিধায় এ জায়গায় বেশি নজর দিতে হবে।

নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম যেভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, তাতে দরিদ্র তো বটেই, নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তের জীবনযাপন কঠিন হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় আয় বাড়ানোর বিকল্প নেই। কিন্তু কীভাবে বাড়বে? করোনার কারণে যেসব শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, সেগুলো সব চালু করা যায়নি। নতুন করে শিল্পকারখানাও খুব বেশি গড়ে উঠছে না।

জরিপে যেসব আত্মকর্মসংস্থানের কথা বলা হয়েছে, সেটা অনেকটা নিরুপায় হয়ে। মানুষকে টিকে থাকতে কিছু না কিছু করতেই হয়। দেখতে হবে আত্মকর্মসংস্থান হোক আর কর্মসংস্থান হোক তা দিয়ে ন্যূনতম মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করা যায় কি না। অনেক ক্ষেত্রেই এর জবাব হবে ‘না’।

তাহলে দারিদ্র্য পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় কী। সামাজিক নিরাপত্তাবলয় প্রসারিত করার পাশাপাশি মানুষের এমন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে, যা দিয়ে তিনি বা তঁারা মৌলিক চাহিদাগুলো মেটাতে পারেন। এ ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত উদ্যোগ না নিয়ে টেকসই ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়াই বাঞ্ছনীয়।