সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

মালিকেরা কি সরকারের চেয়েও ক্ষমতাবান

যখন বুড়িগঙ্গার এপারে খোদ ঢাকা শহরে খাল ও সড়ক দখল করে গড়ে ওঠা সাদিক অ্যাগ্রো ফার্ম উচ্ছেদ করা হচ্ছে, তখনই বুড়িগঙ্গার ওপারে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে বুড়িগঙ্গার তীরে ২৭টি ডকইয়ার্ড গড়ে ওঠার খবর সংবাদমাধ্যমে এসেছে। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন ওঠে, বুড়িগঙ্গাকে ঘিরে এই দখল–উচ্ছেদ খেলা চলতে থাকবে?

প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের পার গেন্ডারিয়ার আপিস মাঠ এলাকায় শুভাঢ্যা খাল বুড়িগঙ্গা নদীর সঙ্গে মিশেছে। এই খাল ও নদীর মধ্যবর্তী তীরের চর কালীগঞ্জের তেলঘাট পর্যন্ত প্রায় দেড় কিলোমিটার এলাকাজুড়ে গড়ে উঠেছে ২৭টি ডকইয়ার্ড বা নৌযান তৈরি ও মেরামত কারখানা। ডকইয়ার্ডের মালিকদের মধ্যে আছেন সংসদ সদস্য, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী আওয়ামী লীগের নেতা। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) কর্মকর্তারা বলছেন, প্রভাবশালী ব্যক্তিরা ডকইয়ার্ডের মালিক হওয়ার কারণে এগুলো উচ্ছেদ করা যাচ্ছে না।

সরেজমিনে দেখা গেছে, আপিস মাঠ এলাকার বুড়িগঙ্গার তীর ঘেঁষে আলু সংরক্ষণাগার (কোল্ডস্টোরেজ) রয়েছে। ওই সংরক্ষণাগার থেকে চর খেজুরবাগ হয়ে তেলঘাট পর্যন্ত শুভাঢ্যা খাল ও নদীর জায়গায় এসব ডকইয়ার্ড গড়ে তোলা হয়েছে। নদীসীমার মধ্যে এতগুলো ডকইয়ার্ড গড়ে ওঠার কারণে আপিস মাঠ এলাকা থেকে তেলঘাট পর্যন্ত বুড়িগঙ্গার প্রশস্ততা কমে গেছে। পোড়া তেলে নদীর পানি দূষিত হচ্ছে।

বরিশাল-৩ আসনের সংসদ সদস্য গোলাম কিবরিয়ার দাবি, তাঁর ডকইয়ার্ড দুটি ব্যক্তিমালিকানাধীন জমিতে গড়ে উঠেছে। কিন্তু বিআইডব্লিউটিএর পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) এ কে এম আরিফ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, শুভাঢ্যার ডকইয়ার্ডগুলো অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে। ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি হলেও সেখানে পরিবেশদূষণকারী স্থাপনা নির্মাণ করা যায় না। দেখতে হবে সেই স্থাপনার কারণে নদী ও পরিবেশদূষণ হচ্ছে কি না। বুড়িগঙ্গার তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা ২৭টি ডকইয়ার্ডের বর্জ্য, আবর্জনা ও পোড়া তেল নদীতেই পড়ছে।

২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে বিআইডব্লিউটিএর সঙ্গে এক বৈঠকে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী কেরানীগঞ্জ থেকে সব ডকইয়ার্ড সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগের জন্য নির্দেশনা দিয়েছিলেন। সাড়ে তিন বছরেও সেই নির্দেশনা বাস্তবায়িত না হওয়া দুর্ভাগ্যজনক।

নৌযান তৈরি ও মেরামতের জন্য ডকইয়ার্ডের প্রয়োজনীয়তা আছে। কিন্তু সেটি রাজধানী ঢাকার চালিকা শক্তি হিসেবে পরিচিত বুড়িগঙ্গাকে হত্যা করে হতে হবে কেন? বুড়িগঙ্গাকে ধ্বংস করতে এর তীরে আগে থেকেই অনেক কারখানা ও স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে। বিআইডব্লিউটিএ মাঝেমধ্যে উচ্ছেদ অভিযান চালালেও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। কিছুদিন পরই উচ্ছেদ হওয়া স্থাপনা পুনর্নির্মাণ করেন প্রভাবশালীরা।

সরকার চর মিরেরবাগ এলাকায় বুড়িগঙ্গার ৯ ও ১০ পিলার ঘেঁষে স্থাপিত একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ২০১৯ সালে ভেঙে দিয়েছে। কিন্তু ১১ ও ১২ নম্বর পিলারের মাঝামাঝি কুমিল্লা ডকইয়ার্ড গড়ে উঠলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এতে প্রমাণিত হয় সরকারের চেয়েও ডকইয়ার্ডের মালিকেরা ক্ষমতাবান।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান নদী রক্ষার জন্য এসব স্থাপনা উচ্ছেদের কোনো বিকল্প নেই উল্লেখ করে দ্রুততম সময়ে দখলমুক্ত করা।

প্রথম আলোর খবরে ডকইয়ার্ডগুলো অন্যত্র সরিয়ে নিতে সরকারের একটি প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন থাকার কথাও বলা হয়েছে। ঢাকা মহানগর ও বুড়িগঙ্গা রক্ষায় ইতিপূর্বে সরকার অনেক প্রকল্প নিয়েছে। কিন্তু সেগুলো হয় বাস্তবায়িত হয় না, অথবা হলেও তাতে নদী রক্ষা পায় না।

 যদি সরকার সত্যি সত্যি বুড়িগঙ্গাকে বাঁচাতে চায়, তাদের উচিত হবে এর দুই তীরের সব স্থাপনা অবিলম্বে উচ্ছেদ করা। আর যদি প্রভাবশালীদের কাছে তারা নতিস্বীকার করতে থাকে, তাহলে মুমূর্ষু বুড়িগঙ্গার শেষচিহ্নটুকুও থাকবে না।