মঙ্গলবার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সম্পাদক পরিষদের বৈঠকটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সম্পাদক পরিষদের সভাপতি ও দ্য ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনামের নেতৃত্বে দেশের শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্রের সম্পাদকদের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার দেড় ঘণ্টা ধরে খোলামেলা আলোচনা হয়েছে। সম্পাদকেরা সংবাদমাধ্যমের বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরার পাশাপাশি মুক্ত সাংবাদিকতার পরিবেশ নিশ্চিত করার ওপর জোর দিয়েছেন।
বৈঠক শেষে মাহ্ফুজ আনাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘একজন সম্পাদক হিসেবে আমি প্রশ্ন উত্থাপন করেছি যে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে যত্রতত্র যে খুনের মামলা হচ্ছে, এটা যেন বন্ধ হয়। এ ব্যাপারে সরকার যেন সুস্পষ্ট একটি ব্যবস্থা নেয়। সাংবাদিকদের যদি কোনো রকম দোষ থাকে, তাঁরা যদি দুর্নীতিতে জড়িত থাকেন, তাঁদের বিরুদ্ধে আলাদা মামলা হবে, কিন্তু এভাবে যেন না হয়।’
অন্যদিকে স্বাধীন ও সক্রিয় গণমাধ্যমের জন্য যা যা করা প্রয়োজন, তা করার আশ্বাস দেওয়ার পাশাপাশি প্রধান উপদেষ্টা সরকার পরিচালনায় তাঁদের ভুলত্রুটি ধরিয়ে দিতে সাংবাদিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। যেখানে অতীতে সরকারপ্রধানেরা সাংবাদিক ও সম্পাদকদের নানাভাবে ভয়ভীতির মধ্যে রাখতেন, সেখানে তাঁর এ বক্তব্য কিছুটা হলেও আমাদের আশ্বস্ত করে।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মুক্ত সাংবাদিকতার সূচকে বাংলাদেশের ক্রমাবনতিতে আমাদের উদ্বেগ বাড়লেও নীতিনির্ধারকেরা সবকিছু ঠিক আছে বলে আত্মপ্রসাদ লাভ করতেন। অস্বীকার করার উপায় নেই যে সে সময় একশ্রেণির সংবাদমাধ্যম সরকারের সব কাজে বাহবা দিত। অতীতের সরকারগুলো বরাবর সংবাদমাধ্যমকে প্রতিপক্ষ ভেবেছে এবং তাদের দুর্নীতি ও দুর্বলতাগুলো নানা কৌশলে আড়াল করতে সচেষ্ট থেকেছে।
এ প্রেক্ষাপটে ড. মুহাম্মদ ইউনূস যে সরকারের ভুলত্রুটি দেখিয়ে দিতে বলেছেন, সেটা খুবই ইতিবাচক বলে ধারণা করি। কিন্তু বিষয়টি কেবল সদিচ্ছার নয়। আইনি খড়্গ রেখে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা আশা করা যায় না। আগে থেকেই বিশেষ ক্ষমতা আইনসহ সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা-পরিপন্থী আইন দেশে জারি ছিল। তদুপরি বিএনপি আমলে প্রণীত আইসিটি আইন, আওয়ামী লীগ আমলে প্রথমে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও পরে সাইবার নিরাপত্তা আইন জারি করা হয়, যা স্বাধীন সাংবাদিকতাকে ভীষণ ঝুঁকিতে ফেলেছে। অনেক সম্পাদক ও সাংবাদিকের মাথার ওপর এখনো সেই কালো আইনে করা মামলার খড়্গ ঝুলছে, প্রতি মাসে তাঁদের আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে।
সম্পাদক পরিষদের পক্ষ থেকে আইনগুলো বাতিল করার দাবি জানিয়ে বলা হয়েছে, এ মুহূর্তে সেটি সম্ভব না হলেও সংশ্লিষ্ট ধারাগুলো যেন সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ব্যবহার না করা হয়। অন্তর্বর্তী সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টা দায়িত্ব নেওয়ার আগে তাঁদের লেখালেখি ও বক্তৃতা-বিবৃতিতে এসব আইন বাতিলের পক্ষে জোরালো ভূমিকা নিয়েছিলেন। এখনো তাঁদের কাছে সেই ভূমিকা প্রত্যাশিত।
প্রধান উপদেষ্টার পক্ষ থেকে স্বাধীন সংবাদমাধ্যম কমিশন গঠনের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সরকারের তত্ত্বাবধানে এসব কমিশন গঠিত হলে কতটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে অংশীজন ও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে কমিশন গঠন করতে হবে। অতীতে সব সরকারই সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সুরক্ষার কথা বলে নানা কমিশন ও আইন করেছে। বাস্তবে সেসব আইন ও কমিশন সংবাদমাধ্যমের অংশীজনদের সুরক্ষা দেওয়ার চেয়ে আরও বেশি ঝুঁকিতে ফেলেছে।
অন্তর্বর্তী সরকার যে একটি গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল ও বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার কথা বলছে, সেটা বাস্তবায়ন করতে হলে সংবাদমাধ্যমের নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা সুরক্ষার বিকল্প নেই। জনগণের অর্থে পরিচালিত সংবাদমাধ্যমে সরকারের নীতিনির্ধারকদের পাশাপাশি বিরোধী পক্ষের কথাও প্রচার করার নিশ্চয়তা থাকতে হবে।
সংবাদমাধ্যমে নির্ভয় ও নিঃশঙ্ক পরিবেশ নিশ্চিত হোক।