সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

সরকারি হাসপাতালে অচল যন্ত্র

স্বাস্থ্য খাত কত দিন জবাবদিহির ঊর্ধ্বে থাকবে

প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে স্বাস্থ্য ব্যয় যখন সর্বোচ্চ, তখন সরকারি হাসপাতালে রোগনির্ণয়ের যন্ত্র অচল পড়ে থাকাটা দুঃখজনক ও অগ্রহণযোগ্য। দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, অদরকারি অবকাঠামো নির্মাণসহ স্বাস্থ্য খাতের নানা অনিয়ম দিনের পর দিন গণমাধ্যমের শিরোনাম হলেও এ খাতের কর্তাব্যক্তিদের তাতে কোনো হেলদোল দেখা যায় না।

এতে প্রশ্ন জাগাটা স্বাভাবিক যে স্বাস্থ্যের কর্তাব্যক্তিরা কি সব জবাবদিহির ঊর্ধ্বে? হাসপাতালের যান ও যন্ত্রপাতি কেনাকাটা ও রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রেও সেই দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে আসার নজির দেখা গেল না।

প্রথম আলোর প্রতিবেদন জানাচ্ছে, সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বিশেষায়িত হাসপাতাল ও জেলা পর্যায়ের হাসপাতালসহ দেশের ৮৪টি হাসপাতালে ৩ হাজার ৩৩১টি যন্ত্রপাতি অচল অবস্থায় পড়ে আছে। এসব যন্ত্রপাতির বাজারমূল্য প্রায় ৮০০ কোটি টাকা। দেশের সব সরকারি হাসপাতাল যুক্ত করলে নিশ্চিতভাবেই এই হিসাব অনেক বেশি হবে। এসব যন্ত্রপাতি মেরামত করা গেলে সেগুলো পুনর্ব্যবহার করা সম্ভব।

মেরামতযোগ্য অচল যান ও যন্ত্রের মধ্যে অ্যাম্বুলেন্স, এক্স-রে মেশিন, ইসিজি যন্ত্র, আলট্রাসনোগ্রাম যন্ত্র, নেবুলাইজার যন্ত্র, এনজিওগ্রাম যন্ত্র, এমআরআইয়ের মতো যন্ত্রও রয়েছে। রোগনির্ণয়, চিকিৎসাসেবা প্রদান ও রোগী পরিবহনের ক্ষেত্রে এসব যন্ত্র ও যান অত্যাবশ্যকীয়। তাহলে কোন যুক্তিতে সেগুলো দিনের পর দিন ফেলা রাখা হয়েছে?

মেরামত না করায় এসব যান ও যন্ত্র একদিকে যেমন নষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যাওয়া রোগীদের অনেক বেশি ব্যয় করে বেসরকারি হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। আমরা দেখতে পাই যে কেন্দ্রীয় ওষুধভান্ডার, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় চিকিৎসা সরঞ্জাম কেনার প্রতি যতটা আগ্রহী, সেগুলো মেরামত করে ব্যবহারের উপযোগী করার ক্ষেত্রে ততটাই অনাগ্রহী।

হাসপাতালে চাহিদা নেই, প্রশিক্ষিত লোকবল নেই, তারপরও যন্ত্রপাতি কিনে হাসপাতালে পাঠিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। ২০১২ সালে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ক্যানসার চিকিৎসার একটি ‘লিনিয়ার অ্যাক্সিলারেটর’ যন্ত্র পাঠানো হয়। এই যন্ত্রের কোনো চাহিদা হাসপাতালটির ছিল না। ১০ কোটি টাকার বেশি দামের যন্ত্রটি বাক্সবন্দী অবস্থায় পড়ে থেকে থেকে পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে।

এই অপচয়ের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের তদন্ত করে জবাবদিহির আওতায় কেন আনা হবে না? এর বিপরীত চিত্রটাও দেখা যাচ্ছে। রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মতো রোগীর ভিড় লেগে থাকা হাসপাতালে এমআরআই যন্ত্রসহ ২২টি যন্ত্র বহুদিন ধরে নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। এ বিষয়ে হাসপাতালটির কর্তৃপক্ষের কাছে একাধিকবার চিঠি দিয়েছেন, কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি। রোগ পরীক্ষা করাতে হাসপাতালের চিকিৎসকেরা রোগীদের নিয়মিতভাবে অন্য হাসপাতালে পাঠাচ্ছেন।

সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যাওয়া রোগীদের সিংহভাগই গরিব জনগোষ্ঠী। সরকারি হাসপাতালে যন্ত্রপাতি অচল হয়ে যাওয়ায় তাদের বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে এসব পরীক্ষা করাতে হচ্ছে। ফলে বাড়তি ব্যয়ের বোঝা তাদের কাঁধে গিয়ে চাপছে।

এমনিতেই বাংলাদেশে চিকিৎসার ক্ষেত্রে রোগীর পকেট থেকে ব্যয়ের পরিমাণ বাড়ছেই। জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ যথার্থই বলেছেন, বাংলাদেশের মানুষের চিকিৎসা ব্যয় বেশি হওয়ার একটি প্রধান কারণ রোগনির্ণয় ব্যয় বেশি। সরকারি হাসপাতালে প্রয়োজনীয় রোগনির্ণয়ের ব্যবস্থা থাকলে এটা হতো না।

প্রশ্ন হলো স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অবহেলা, অমনোযোগের কারণে সাধারণ মানুষের ঘাড়ে কেন চিকিৎসার বাড়তি বোঝা চাপবে? কেন তারা স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হবে? সরকারি হাসপাতালের জন্য যন্ত্রপাতি ক্রয়, ব্যবস্থাপনা ও মেরামত করার কেন্দ্রীয় কোনো সুস্পষ্ট নীতিমালা না থাকার সুযোগটা ব্যবহার করেন অনেকে। এ ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। অচল যন্ত্রগুলো দ্রুত মেরামত করে ব্যবহারের উপযোগী করতে হবে। স্বাস্থ্য খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জবাবদিহির মধ্যে আনতে হবে।