সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

সরকারি সংস্থা কি জবাবদিহির ঊর্ধ্বে

সম্প্রতি একের পর এক বিস্ফোরণে ভবনধস ও হতাহত হওয়ার ঘটনা জনমনে শঙ্কা ও আতঙ্কের জন্ম দিয়ে চলেছে। তদন্তের পর বেরিয়ে আসছে এসব দুর্ঘটনার পেছনে ভবনমালিক এবং রাজউক, তিতাসসহ সেবা সংস্থাগুলোর যৌথ অনিয়ম ও গাফিলতির ভয়াবহ সব চিত্র।

ব্যক্তিমালিকানাধীন ভবনগুলোতে অনিয়মের এ মহামারি যখন নাগরিকের জানমালের নিরাপত্তার মৌলিক প্রশ্নটিই প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে, সে সময় সরকারি সংস্থার মধ্যেও প্রচলিত আইন ও বিধিমালার তোয়াক্কা না করার রীতি তৈরি হয়েছে। এর সর্বশেষ নজির আমরা দেখতে পেলাম সাভারে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের নির্মাণাধীন ভবনের ক্ষেত্রে।

প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, ১০ মার্চ বিকেলে সাভারের আশুলিয়ার গণকবাড়ী এলাকায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন পরমাণু শক্তি কমিশনের নির্মাণাধীন ভবনের দশম তলার ছাদের একটি অংশ ধসে পড়ে। এ ঘটনায় ১৬ নির্মাণশ্রমিক আহত হন, যাঁদের মধ্যে ৩ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।

সাভারের যে এলাকায় ভবনটি নির্মাণ করা হচ্ছে, সেটি রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) অঞ্চল-১-এর আওতাধীন এবং সংস্থাটির প্রণয়ন করা ঢাকা মহানগর এলাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (ড্যাপ) অন্তর্ভুক্ত। প্রচলিত ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী, ড্যাপের আওতাধীন এলাকায় ভবন নির্মাণ করতে হলে রাজউক থেকে অনুমোদন নেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

বিকল্প হিসেবে কেবল স্থাপত্য অধিদপ্তরের ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেওয়ার এখতিয়ার আছে। কিন্তু ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে পরমাণু শক্তি কমিশন কারও কাছ থেকে অনুমোদন নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি। সরকারি সংস্থা যখন অনুমোদন ছাড়া এভাবে ভবন নির্মাণ করে, তখন ব্যক্তিমালিকানাধীন ভবনের ক্ষেত্রে কী ঘটছে, সেটা সহজেই অনুমেয়।

দুর্ঘটনার পরদিন ভবনটি পরিদর্শনে যান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান। ভবনটির নির্মাণকাজে কিছুটা গাফিলতি ছিল বলে তিনি স্বীকার করেন। পরবর্তী সময়ে এ ধরনের অঘটন যাতে না ঘটে, সেটা নিশ্চিত করার কথাও বলেন তিনি। কিন্তু যে ভবন শুরু থেকেই ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ভঙ্গ করে নির্মিত হচ্ছে, সেখানে সব মান নিশ্চিত করে এর নির্মাণকাজ চলছে কি না, তা নিয়ে বড় প্রশ্ন থেকে যায়।

যদিও প্রকল্প পরিচালকের ভাষ্য হচ্ছে, ভবনটির অনুমোদন আছে এবং তাঁদের নিজস্ব পরিচালকেরা নির্মাণ তদারকির কাজ করছেন। কিন্তু রাজউক ও স্থাপত্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা স্পষ্ট করে জানিয়েছেন পরমাণু শক্তি কমিশন তাদের কাছ থেকে অনুমোদন নেয়নি।

তাহলে এ অনুমোদন তারা পেল কোথা থেকে? সরকারি সংস্থা বিদ্যমান আইনের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করে যখন ভবন নির্মাণ করে, সেটি নিঃসন্দেহে খারাপ দৃষ্টান্ত তৈরি করে। সাধারণ নাগরিকেরা তাতে আইন অমান্য করতে উৎসাহিত হন।

নির্মাণাধীন ভবনের ছাদ ধসে পড়ার পর এখন রাজউক বলছে যে সেটি নির্মাণে তাদের কাছ থেকে অনুমোদন নেওয়া হয়নি। প্রশ্ন হলো, সাত বছর ধরে রাজউকের চোখের সামনেই তো অনুমোদনহীন ভবনটির নির্মাণকাজ চলছে, কেন তারা এত দিনেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। সরকারি সংস্থা হোক আর ব্যক্তিমালিকানাধীন হোক, ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে বিধিমালা ভঙ্গ হচ্ছে কি না, সেটা দেখার দায়িত্ব রাজউকের। দুর্ঘটনা ঘটার পর সক্রিয় হওয়ার এ খারাপ দৃষ্টান্ত থেকে রাজউককে অবশ্যই বেরিয়ে আসতে হবে।

অনুমোদন ছাড়া কোনো ভবন নির্মিত হলে তাকে অবৈধ হিসেবেই বিবেচনা করতে হবে। আর অনুমোদন নেওয়ার পরও বিধিমালা লঙ্ঘন করলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠানকে অবশ্যই প্রচলিত আইনের আওতায় আনতে হবে। সরকারি সংস্থা বলে কি পরমাণু শক্তি কমিশন জবাবদিহির ঊর্ধ্বে? রাজউক যেহেতু অনুমতি দেয়নি, তাই এই ভবন অবৈধ। এই অবৈধ ভবনের বিরুদ্ধে তারা কী ব্যবস্থা নেয়, সেটাই দেখার বিষয়।