ঢাকার পরিবহন খাতের অব্যবস্থাপনা ও চাঁদাবাজির প্রভাব নগরবাসীর জীবনে গভীর ছাপ ফেলেছে। বিশেষ করে মহাখালী বাস টার্মিনালে প্রতিদিন যে সাড়ে ১০ লাখ টাকা চাঁদা তোলা হচ্ছে, তা এক মারাত্মক পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছে। এ টার্মিনালে চাঁদাবাজির ঘটনায় বিএনপির দুই প্রভাবশালী নেতা—ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক সাইফুল আলম নিরব ও কুমিল্লা উত্তর জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক সাইফুল আলমের নাম বারবার উঠে এসেছে। রাজনৈতিক ক্ষমতা ও প্রভাব ব্যবহার করে তাঁরা পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি চালিয়ে যাচ্ছেন বলে জানা যাচ্ছে।
চাঁদাবাজির এই ভয়াবহতা শুধু অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিকর নয়; বরং এটি পরিবহন খাতের স্বাভাবিক কার্যক্রমকেও ব্যাহত করছে।
মহাখালী বাস টার্মিনাল ও আশপাশের রাস্তাগুলোতে বাস পার্কিংয়ের সময়, নতুন বাসের নিবন্ধনসহ নানা কর্মকাণ্ডে অবৈধভাবে অর্থ আদায় করা হয়। এমনকি যে বাসগুলো টার্মিনালের সামনের রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করে, তারাও চাঁদাবাজির শিকার হয়। এই চাঁদাবাজি দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে, যা পরিবহনশ্রমিক ও মালিকদের ওপর অযাচিত চাপ সৃষ্টি করেছে। এর ফলে পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি পায়, যার প্রভাব শেষ পর্যন্ত সাধারণ যাত্রীদের ওপর এসে পড়ে।
এত কিছুর পরও চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। রাজনৈতিক নেতাদের প্রভাবের কারণে এ অবস্থা আরও জটিল আকার ধারণ করেছে। বিশেষ করে সাইফুল আলম নিরবের নেতৃত্বে মহাখালীসহ আশপাশের টার্মিনাল ও সড়কগুলোতে চাঁদাবাজি চলছে। শুধু মহাখালী বাস টার্মিনাল নয়, তেজগাঁও ট্রাক টার্মিনালেও এ ধরনের চাঁদাবাজির নজির রয়েছে। টার্মিনালের দোকান ও অন্যান্য স্থাপনা থেকেও নিয়মিতভাবে অর্থ আদায় করা হচ্ছে, যা শ্রমিকদের জন্য অপমানজনক এবং অর্থনৈতিক চাপের কারণ।
চমকপ্রদ বিষয় হলো, তেজগাঁও টার্মিনাল দীর্ঘদিন ধরে যাঁর নিয়ন্ত্রণে ছিল, সেই শ্রমিক লীগ নেতা তালুকদার মনির এখন বিএনপির নেতা নিরবের সঙ্গে ভিড়ে গিয়ে আগের মতো চাঁদাবাজি চালিয়ে যাচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে নিরব ও মনিরকে ‘মাসতুতো ভাই’-এর ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে।
এ ধরনের পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে হলে অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। প্রথমত, চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত বক্তিদের শনাক্ত করে তাঁদের আইনের আওতায় আনতে হবে। কোনো রাজনৈতিক প্রভাবই এ ধরনের অপরাধীদের রক্ষা করতে পারবে না, তা নিশ্চিত করা জরুরি। দ্বিতীয়ত, পরিবহন খাতে স্বচ্ছতা আনার জন্য আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে। সিসিটিভি ক্যামেরা, ইলেকট্রনিক টিকেটিং ব্যবস্থা এবং বাস টার্মিনালের কার্যক্রম ডিজিটালাইজেশন করা যেতে পারে। এর মাধ্যমে চাঁদাবাজির মতো অনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ করা সহজ হবে।
তৃতীয়ত, পরিবহনশ্রমিক ও মালিকদের সুরক্ষার জন্য একটি শক্তিশালী আইন প্রণয়ন করা দরকার। সরকারকে পরিবহন খাতের ওপর থেকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে। মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলোর নামে চাঁদাবাজির যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, তা দ্রুত বন্ধ করতে হবে। চাঁদাবাজির ফলে পরিবহন খাতের ব্যয় বাড়ে এবং যাত্রীদের ভাড়া বৃদ্ধির মুখে পড়তে হয়, যা অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর।
পরিবহন খাতে সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হলে সব ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে হবে। শুধু আইন প্রণয়ন বা প্রযুক্তির ব্যবহার নয়; বরং এ খাতের প্রতিটি স্তরে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। চাঁদাবাজিমুক্ত পরিবহনব্যবস্থা নগরবাসীর জন্য এক বিশাল স্বস্তি বয়ে আনবে, যা সমাজের সামগ্রিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।