সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

শ্রমজীবী মানুষ

উন্নয়নের স্বার্থেই জীবনমানের উন্নয়ন জরুরি

ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ইউনিয়ন কনফেডারেশনের (আইটিইউসি) বৈশ্বিক অধিকার সূচক ২০২৩-এ বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষের নাজুক চিত্রই উঠে এসেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, শ্রমজীবী মানুষের জন্য বিশ্বের ‘সবচেয়ে বাজে’ ১০টি দেশের একটি বাংলাদেশ। বাকি নয়টি দেশ হলো বেলারুশ, ইকুয়েডর, মিসর, এসওয়াতিনি, গুয়াতেমালা, মিয়ানমার, তিউনিসিয়া, ফিলিপাইন ও তুরস্ক। ১৪৯টি দেশকে অন্তর্ভুক্ত করে আইটিইউসি এবারের প্রতিবেদন তৈরি করেছে।

প্রতিবেদনে যে বিষয়টির ওপর জোর দিয়েছে, সেটি হলো বাংলাদেশে শ্রমজীবী মানুষের অধিকারের নিশ্চয়তা নেই।

শ্রমিকদের অনিশ্চয়তার কারণ হিসেবে পশ্চাৎমুখী আইন, ইউনিয়ন গঠনে বাধা এবং শ্রমিকদের ওপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সহিংসতার কথা বলা হয়েছে। ঔপনিবেশিক আমল থেকে শ্রমিকদের সংগঠন ও দর-কষাকষি করার অধিকার ছিল, সেটাও অনেকটা সীমিত। বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য গঠিত আটটি রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (ইপিজেড) এ শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের অধিকার নেই।

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শিল্প খাত তৈরি পোশাক কারখানায় ৪৫ লাখের বেশি শ্রমিক কাজ করেন। এখানে ন্যূনতম মজুরির নিশ্চয়তা দেওয়া হলেও সেটি একজন শ্রমিকের ন্যূনতম মৌলিক চাহিদা মেটানোর জন্য অপ্রতুল। অনেক কারখানায় শ্রমিকদের নিয়মিত মজুরিও দেওয়া হয় না। এ নিয়ে তৈরি পোশাকশিল্পে মাঝেমধ্যেই অসন্তোষ দেখা যায়। ঈদের আগে ২৫ জুন মজুরি-ভাতা বকেয়া থাকায় গাজীপুরে প্রিন্স জ্যাকার্ড সোয়েটার লিমিটেড নামের একটি কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দিলে বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল শ্রমিক ফেডারেশনের নেতা শহিদুল ইসলাম সেখানে যান তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করতে। ফেরার পথে তিনি সন্ত্রাসী হামলার শিকার হন। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।

শহিদুল হত্যা মামলায় আসামি গ্রেপ্তারে পুলিশ গড়িমসি করছে বলে অভিযোগ আছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর শ্রমিকদের সঙ্গে তুলনা করলেও বাংলাদেশের শ্রমিকদের বেতন কম। রানা প্লাজা ধসের পর তৈরি পোশাকশিল্পের কর্মপরিবেশ কিছুটা উন্নত হলেও বেশির ভাগ খাতের অবস্থা শোচনীয়।

বর্তমানে বাংলাদেশের শ্রমিকেরা যে মজুরি পান, তা দিয়ে মানবিক জীবনযাপন করে শ্রমশক্তি পুনরুৎপাদন করা কঠিন। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসাসহ মৌলিক চাহিদা পূরণে যতটা আয় প্রয়োজন, তার তুলনায় অর্ধেক আয় করেন দেশের তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিকেরা। বাংলাদেশে ৮০ শতাংশ শ্রমিক কাজ করেন অনানুষ্ঠানিক খাতে। সেখানে ন্যূনতম মজুরি ও কর্মঘণ্টার বালাই নেই। কর্মপরিবেশ অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।

যেখানে সরকারের নীতিনির্ধারকেরা উন্নত ও সমৃদ্ধ অর্থনীতির স্বপ্ন দেখছেন, সেখানে শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নের বিকল্প নেই। যেসব দেশ অর্থনৈতিকভাবে উন্নত হয়েছে, সেসব দেশে শ্রমিকদের জীবনমানও অনেক উন্নত। বাংলাদেশে ২০০৬ সালে যে শ্রম আইন প্রণীত হয়েছে, সেই আইনে শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষার জন্য যথেষ্ট নয়। তদুপরি সরকার ও মালিকপক্ষ আইনকে উপেক্ষা করে শ্রমিকদের অধিকার খর্ব করছে।

আন্তর্জাতিক অনেক সূচকেই আমরা পেছনে আছি। তাই বলে সবচেয়ে বাজে ১০টি দেশের তালিকায় থাকা কোনোভাবে মানা যায় না। আমরা যদি প্রকৃতই দেশকে উন্নয়নের মহাসড়কে নিয়ে যেতে চাই, শ্রমিকদের জীবনমানেরও উন্নয়ন জরুরি। শ্রমিকদের অর্ধাহারে কিংবা মানবেতর পরিবেশে রেখে তাঁদের কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত শ্রম বা সেবা পাওয়ার আশা করা যায় না। তাঁদের ন্যূনতম মজুরি, উপযুক্ত কর্মপরিবেশ ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতেই হবে।