ডলার–সংকট, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া, নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে দেশের অর্থনীতি আগে থেকেই বেশ চাপে। শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সহিংসতা, কারফিউ জারি, ইন্টারনেট সেবা বন্ধের মতো কঠোর পদক্ষেপ যে অর্থনীতিকে কঠিন অবস্থার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
রপ্তানিমুখী কারখানা বন্ধ থাকায় বাংলাদেশের বিশাল ক্ষতি হয়েছে বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা। পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি আবদুল মান্নান বলেছেন, কয়েক দিনের স্থবিরতায় প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে বিজিএমইএর সরাসরি রপ্তানিতে ক্ষতি হয়েছে ৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। নিট পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেমের মতে, এক দিন কারখানা বন্ধ থাকলে ১৬ কোটি ডলারের আর্থিক ক্ষতি হয়, যা দেশি মুদ্রায় ১ হাজার ৭২৮ কোটি টাকা।
বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, গত এক সপ্তাহে অর্থনীতির ক্ষতি হয়েছে ৮৪ হাজার কোটি টাকার বেশি। চলমান স্থবিরতায় দিনে অর্থনীতির ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা। অর্থনীতির ক্ষতি হয়তো টাকার অঙ্কে মাপা যায়, কিন্তু দেশের ভাবমূর্তির যে ক্ষতি হয়েছে, তা মাপার কোনো বাটখারা নেই।
দেশের ব্যাংকগুলোর আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পুরোপুরি ইন্টারনেটনির্ভর। আমদানি-রপ্তানির ঋণপত্র (এলসি) খোলার জন্য বিদেশি ব্যাংকগুলোর সঙ্গে ই-মেইলসহ বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগ করতে হয়। ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় বিদেশি ব্যাংক ও ক্রেতা-বিক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ পুরোপুরি বন্ধ ছিল। গত বুধবার সীমিত পরিসরে ইন্টারনেট সেবা চালু হয়েছে। শিল্পকারখানাগুলোতে উৎপাদন শুরু হয়েছে। ব্যাংক, সরকারি–বেসরকারি দপ্তরও গত দুই দিন সীমিত সময়ের জন্য চালু ছিল। বুধবার চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে শুল্কায়নের জন্য প্রায় ৭ হাজার ৮১৯টি আমদানি-রপ্তানি চালানের নথি অনলাইনে দাখিল করেছেন ব্যবহারকারীরা। বন্দর থেকে পণ্য খালাসও পুরোদমে শুরু হয়েছে।
ঢাকার সঙ্গে দেশের অন্যান্য এলাকার যোগাযোগ বন্ধ থাকার পর গতকাল বৃহস্পতিবার ট্রেন ও সড়ক যোগাযোগও চালু হয়েছে। কিন্তু অর্থনীতির চাকা পুরোপুরি সচল করতে হলে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে যে সংকট তৈরি হয়েছে, সেটা পুরোপুরি দূর করতে হবে। সরকারের নীতিনির্ধারকেরা শুক্রবারের পরিস্থিতি দেখে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা বলেছেন।
কিন্তু যখন সরকার সবকিছু স্বাভাবিক মনে করছে, তখন সবকিছু খুলে দিতে দেরি কেন? জনজীবনে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে যা করার, এখনই করতে হবে। সরকারের নীতিনির্ধারকেরা একদিকে বলেছেন কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সহিংসতা ও ধ্বংসযজ্ঞের সঙ্গে শিক্ষার্থীরা জড়িত নন, অন্যদিকে অজ্ঞাতসংখ্যক আন্দোলনকারীর নামে একের পর এক মামলা করা হচ্ছে। এটা নিশ্চিতভাবেই স্ববিরোধী অবস্থান। ইতিমধ্যে কোটা সংস্কার আন্দোলনের কয়েকজন নেতাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে নির্যাতন করার অভিযোগ এসেছে। এগুলোর সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া প্রয়োজন।
দেশের অর্থনীতির অনেক ক্ষতি হয়েছে। কোটা সংস্কারের মতো একটি অরাজনৈতিক ইস্যুকে কেন্দ্র করে দুই শতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। অনেকে চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেছেন। দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন। এই ক্ষতি আর বাড়তে দেওয়া যায় না। যাঁরা সম্পদ ধ্বংস করেছেন, তদন্ত সাপেক্ষে তাঁদের বিরুদ্ধে সরকার আইনি ব্যবস্থা নিক। কিন্তু নির্দোষ কাউকে হয়রানি করা যাবে না।
জনজীবনে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে সব নাগরিকের নিরাপত্তা ও গণতান্ত্রিক অধিকারের পাশাপাশি ভয়হীন পরিবেশ নিশ্চিত করা হোক।