সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব

নেতিবাচক প্রভাব পড়বে শিল্পকারখানায়

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের কথা বলে গ্যাসের দাম ১৫০ শতাংশের বেশি বাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু তারা গ্যাস-সংকটের সমাধান করতে পারেনি; অনেক এলাকায় গ্যাস–বিদ্যুতের ঘাটতির কারণে শিল্পকারখানা চলছে রেশনিং পদ্ধতিতে। অন্তর্বর্তী সরকার গ্যাস–সংকটের সমাধান না করে নতুন করে গ্যাসের দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। এতে শিল্পকারখানায় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন জ্বালানিবিশেষজ্ঞ ও ব্যবসায়ীরা।

প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, জ্বালানি বিভাগের অনুমোদন নিয়ে দাম বাড়াতে গত সোমবার বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) কাছে প্রস্তাব করেছে বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা)। এতে প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ৩০ টাকা বাড়িয়ে ৭৫ টাকা ৭২ পয়সা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে নতুন সংযোগের ক্ষেত্রে পুরো গ্যাস বিল হবে নতুন দামে। তবে পুরোনোদের ক্ষেত্রে কিছুটা ছাড় থাকছে প্রস্তাবে।

পেট্রোবাংলার তথ্য থেকে জানা যায়, বর্তমানে দেশে দিনে গ্যাসের অনুমোদিত লোড ৫৩৫ কোটি ঘনফুট। এর বিপরীতে দিনে ৩৮০ থেকে ৪০০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা আছে। সর্বোচ্চ সরবরাহ করা হয় ২৮০ থেকে ৩০০ কোটি ঘনফুট। অর্থাৎ ঘাটতি থাকছে দিনে ১০০ থেকে ১২০ কোটি ঘনফুট। সরবরাহ করা গ্যাসের মধ্যে ৭৫ শতাংশ আসে দেশি গ্যাস থেকে আর বাকি ২৫ শতাংশ আমদানি করা এলএনজি থেকে।

উদ্বেগের বিষয় হলো দেশি গ্যাসের উৎপাদন ক্রমেই কমছে। অন্যদিকে নতুন এলএনজি টার্মিনাল নির্মিত না হলে আমদানিও বাড়ানো যাবে না। আগামী দুই বছরেও নতুন টার্মিনাল চালুর তেমন সম্ভাবনা নেই। টার্মিনাল নির্মাণে নতুন কোনো চুক্তি হয়নি। আওয়ামী লীগ আমলের একটি চুক্তি বাতিল করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এ অবস্থায় দেশের শিল্প খাত দ্বিমুখী সংকটে পড়বে। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানিবিষয়ক বিশেষ সহকারী ম তামিম প্রথম আলোকে বলেন, প্রস্তাবিত দাম শিল্পের জন্য খুবই কঠিন হবে।

বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম মনে করেন, দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত শিল্পায়নকে নিরুৎসাহিত করবে। শিল্পে নতুন বিনিয়োগ আসবে না, কর্মসংস্থানও হবে না। বিদেশি বিনিয়োগও আসবে না। এর আগে ব্যবসায়ীরা বলেছিলেন, নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ করা হলে তাঁরা বেশি দাম দিতে রাজি আছেন। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে আশ্বাস দেওয়া হলেও তা বাস্তবায়নি হয়নি। পরে গ্যাস না পেয়ে ব্যবসায়ীরা দাম কমানোর দাবি জানিয়েছিলেন। সাম্প্রতিক কালে শিল্প খাত নানা সংকটের মুখে। শ্রমিক অসন্তোষ ও বেতন–ভাতা বকেয়া থাকার কারণে বেশ কিছু কারখানা ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। এই অবস্থায় গ্যাসের দাম বাড়লে শিল্পোদ্যোক্তারা আরও বিপদে পড়বেন।

পেট্রোবাংলা যখন লোকসানের অজুহাত তুলে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে, তখন গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সিপিডি জ্বালানি তেলের দাম গবেষণা করে বলেছে, জ্বালানি তেলের দাম প্রতি লিটার পেট্রলে আরও ১৫ টাকা কমানো সম্ভব। তাদের দাবি, প্রচলিত উপায়ে ভোক্তার কাঁধে বাড়তি ব্যয়ের দায় চাপিয়ে স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণের নামে যে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে, তা অগ্রহণযোগ্য।

গ্যাসের দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রেও শুভংকরের ফাঁকি আছে কি না, সেটা বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। গ্যাসের দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে সরকারের আরও চিন্তাভাবনা করা উচিত বলে মনে করি। আর দাম যদি একান্ত বাড়াতেই হয়, সেটা সহনীয় মাত্রায় হতে হবে। সরকারের নীতিনির্ধারকদের মনে রাখতে হবে, গ্যাসের দাম বাড়লে উৎপাদিত পণ্যের দামও বেশি পড়বে। তখন মূল্যস্ফীতির পাগলা ঘোড়া সামাল দেওয়া যাবে না কোনোভাবেই। দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিইআরসি নিশ্চয়ই এসব বিবেচনায় রাখবে। দাম উল্টো কমানো যায় কি না; সেটিও খতিয়ে দেখা উচিত বিইআরসির।