সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

আরাভ খানকে বিদেশে পার করল কে

পুলিশ কর্মকর্তা মামুন এমরান খুনের আসামি রবিউল ইসলাম ওরফে আরাভ খানকে দুবাই থেকে দেশে ফিরিয়ে আনতে পুলিশ এখন ইন্টারপোলের মাধ্যমে চেষ্টা করছে, রেড নোটিশ জারি করারও প্রস্তুতি নিচ্ছে।

এই সূত্রে কিছু জরুরি প্রশ্ন হচ্ছে; আসামি যখন দেশে ছিলেন, তখন পুলিশ কেন তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারল না? কে বা কারা তাঁকে বিদেশে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন? সবচেয়ে গুরুতর প্রশ্ন হচ্ছে, দুবাই থেকে তিনি দুই দফা দেশে এসে ঘুরে গেলেও আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা তাদের গোয়েন্দারা কেন কিছুই জানতে পারলেন না?

২০১৮ সালের ৭ জুলাই ঢাকার বনানীর একটি ফ্ল্যাটে খুন হন পুলিশের বিশেষ শাখার পরিদর্শক মামুন এমরান। ওই মামলার অন্যতম আসামি রবিউল ইসলাম ভারতে পালিয়ে যান এবং সেখানে আরাভ খান নামে পাসপোর্ট করে দুবাই চলে যান। সেখানে গিয়ে যে তিনি নিজেকে লুকিয়ে রেখেছিলেন, এমন নয়।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও তিনি সক্রিয় ছিলেন। কিন্তু পুলিশ খুনের একজন আসামি এরপরও কীভাবে পুলিশের জানার বাইরে থাকেন, সেটা সত্যিই বিস্ময়কর। সম্প্রতি দুবাইয়ে আরাভ খানের সোনার দোকানের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের ক্রীড়া ও চলচ্চিত্র অঙ্গনের কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে আমন্ত্রণ জানালে বিষয়টি অনেকের নজরে আসে এবং আলোচনা শুরু হয়।

মামুন হত্যা মামলায় ২০১৯ সালের ৩১ মার্চ রহমত উল্লাহ, রবিউল ইসলামসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। রবিউল নিজে বাঁচতে চাঁদপুরের আবু ইউসুফ নামের এক যুবককে তাঁর পরিবর্তে আদালতে আত্মসমর্পণ করান। বিনিময়ে আবু ইউসুফকে নিয়মিত মাসোয়ারা দিতেন। প্রায় ৯ মাস জেল খেটে সত্য প্রকাশ করেন ইউসুফ।

তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রের বরাতে প্রথম আলো যেসব তথ্য দিয়েছে, তা ভয়ংকর। মামুন হত্যার ঘটনায় সে সময় ডিবি পুলিশ তাঁকে আটক করে। কিন্তু তিন দিন পর তাঁকে গ্রেপ্তার না দেখিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। ক্ষমতাসীন দলের তৎকালীন একজন প্রবীণ প্রভাবশালী নেতা এবং পুলিশের এক অতিরিক্ত মহাপরিদর্শকের অনুরোধে ডিবি তাঁকে ছেড়ে দিয়েছিল বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনা নিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সম্মিলিত ব্যর্থতা ও স্বেচ্ছাচারিতাকে সামনে নিয়ে আসে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাজ করার কথা আইনের ভিত্তিতে। তারা কারও নির্দেশ বা অনুরোধে কোনো আসামিকে ছেড়ে দিতে পারে না। পুলিশ কর্মকর্তা মামুন হত্যার ক্ষেত্রে দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেটাই ঘটেছে। যে প্রবীণ নেতা ও পুলিশ কর্মকর্তার অনুরোধে রবিউলকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল, তাঁদের চিহ্নিত করে বিচারের মুখোমুখি করা এখন সরকারের দায়িত্ব।

হত্যা মামলার আসামির দেশত্যাগের ঘটনা এটাই প্রথম নয়। কিন্তু আরাভ খানের ঘটনা সবকিছুকে ছাড়িয়ে গেছে। তিনি কার্যত দেশের আইনশৃৃঙ্খলা বাহিনীর শক্তি-সামর্থ্যকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারের ভাবমূর্তি রক্ষায় এখন আরাভ খান–সংক্রান্ত সবকিছুর রহস্যভেদ জরুরি। এটা স্পষ্ট যে শক্তিশালী কোনো মহলের আশীর্বাদ ছাড়া তঁার পক্ষে এটা করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। কাদের সহায়তা ও সমর্থনে পুলিশ খুনের আসামি রবিউল ইসলাম দেশ থেকে পালিয়ে আরাভ খানে পরিণত হয়েছেন, যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে তা খুঁজে বের করতে হবে।

একই সঙ্গে আরাভ খানকে দুবাই থেকে দেশে ফেরত আনার প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নিতে হবে। তাঁকে দেশে আনতে না পারলে তাঁর নানা অপকর্মের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের মুখোমুখি করা কঠিন হবে। আরাভ খান কীভাবে অঢেল সম্পদের মালিক হলেন, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। অবৈধভাবে অর্জিত বাংলাদেশি কারও টাকা রবিউলের মাধ্যমে দুবাইয়ে পাচার হয়েছে কি না, সেই তদন্ত সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করতে হবে।