সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

আরইবির অব্যবস্থাপনা দূর করুন

গ্রাম ভালো থাকলে শহরও বাঁচবে, দেশটাও এগোবে—এই মুখস্থ সদ্ভাষণের বাইরের সর্বজনবিদিত সত্যটা হলো, শহরকেন্দ্রিক উন্নয়ন ও শিক্ষিত সুবিধাভোগী সম্প্রদায়ের তুষ্টিবিধানে গ্রামকে আগেও উপেক্ষা করা হয়েছে; এখনো করা হচ্ছে।

নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ–সুবিধা নিশ্চিতকরণ প্রশ্নে গ্রামাঞ্চলের প্রতি পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) দৃশ্যমান স্থূল উপেক্ষা তার বড় উদাহরণ।

রাজধানীসহ সব মহানগরাঞ্চলে কারিগরি ত্রুটি বা অন্য কোনো কারণে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হলে সংকট সমাধানে বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষকে যতটা ব্যগ্রতায় উদ্যোগী হতে দেখা যায়, গ্রামাঞ্চলের বিদ্যুৎ–বিভ্রাট নিরসনে সে উদ্যোগের অনুপস্থিতি অতিশয় হতাশাপ্রদায়ক।

সরকারি ঘোষণানুযায়ী দেশের শতভাগ মানুষ বিদ্যুৎ–সুবিধার আওতায় এসেছে। দেশের সবখানে বিদ্যুতের সংযোগ পৌঁছেছে—এই অর্থে হয়তো কথাটি সত্য। কিন্তু সংযোগ প্রাপ্তি আর নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের সুবিধাপ্রাপ্তি এক নয়। সেচের পানির নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত না করে বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠের সর্বত্র নালা তৈরির মতোই তা অর্থহীন।

বাস্তবতার নিরিখে দেখা যাচ্ছে, দেশের ৪৬২টি উপজেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহের দায়িত্বে থাকা পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) তার প্রতিষ্ঠার ৪৭ বছরেও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি।

বিদ্যুৎ-ঘাটতি থাকলে নিয়মিত লোডশেডিংকে তবু স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে মেনে নেওয়ার মধ্যে সান্ত্বনা খোঁজা যায়। কিন্তু বিদ্যুৎ ঘাটতি না থাকার পরও বিদ্যুৎ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে গ্রামের মানুষ। সামান্য ঝড়–বৃষ্টি হলেই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বিদ্যুৎ সরবরাহ। কখনো কখনো বিদ্যুৎ ফিরে আসতে লেগে যায় কয়েক দিন।

দেশের ৮০ শতাংশ এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহের দায়িত্ব নেওয়া আরইবি এই ব্যর্থতা আড়াল করতে আত্মপক্ষ সমর্থনে নানা যুক্তিই সামনে আনতে পারে। তবে এই দায়িত্ব পালনে দক্ষতা, সক্ষমতা, জনবল কোনোটিই কার্যত আরইবির নেই। তাদের ভঙ্গুর বিতরণব্যবস্থার কারণে সাধারণ গ্রাহক শতভাগ বিদ্যুতায়নের সুফল পাচ্ছে না।

আরইবির কর্তারা বলছেন, ঢাকার বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইনের ত্রুটি শনাক্ত করা যায় স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়ায়। কিন্তু আরইবির বিতরণ লাইন লম্বা। বনজঙ্গল, বাড়িঘর, গাছপালার মধ্য দিয়ে এসব লাইন চলে গেছে। তাই ত্রুটি শনাক্তে ভুক্তভোগী স্থানীয় মানুষের অভিযোগের ওপরই তাদের নির্ভর করতে হয়। কেউ না জানালে ত্রুটি শনাক্ত করতেই লম্বা সময় লেগে যায়।

যদি স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রব্যবস্থার অভাবই নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ নিশ্চিতের পথের প্রধান অন্তরায় হয়ে থাকে, তাহলে যথাযথ প্রযুক্তির সংযোজনকে তাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারে বিবেচনা করা দরকার এবং সে ধরনের প্রযুক্তি সংযোজনে সরকারেরও মনোযোগী হওয়া দরকার।

আরইবির সাবেক কর্মকর্তারা বলছেন, আরইবির কিছু কারিগরি সমস্যা, জনবলের ঘাটতি আছে। এটি তো সব সময় ছিল; কিন্তু এক বছর আগেও বিদ্যুৎ-বিভ্রাটের সমস্যা এতটা ছিল না। তার অর্থ কেন্দ্র থেকে এখন মাঠপর্যায়ে নজরদারি কমেছে।

বিদ্যুতের লাইনে ত্রুটি দেখা দিলে তা সারাইয়ের বিলম্বের পাশাপাশি ঘন ঘন লোডশেডিং গ্রামাঞ্চলে নিত্যকার ঘটনা হয়ে উঠেছে।

তবে আশার কথা, স্বয়ংক্রিয়ভাবে ত্রুটি শনাক্তে পরীক্ষামূলক প্রকল্প নিয়েছে আরইবি। এখন সারা দেশের বিতরণ লাইনে এটি করা হচ্ছে। প্রতি পাঁচ কিলোমিটার পরপর ত্রুটি শনাক্তের একটি যন্ত্র বসানো হচ্ছে। এতে বিতরণ লাইনে কোনো সমস্যা দেখা দিলে বা গাছ পড়লে দ্রুত শনাক্ত করা যাবে।

এই উদ্যোগকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারে এগিয়ে নেওয়া জরুরি। এতে অন্তত বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রশ্নে, বিশেষত গ্রামাঞ্চলের প্রতি সরকারের বৈষম্যের অভিযোগ কিছু হলেও লাঘব হবে।