অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য যোগাযোগ অবকাঠামোর উন্নয়ন জরুরি। কিন্তু সেই অবকাঠামো উন্নয়নে যদি জনগণের সুবিধার চেয়ে ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর স্বার্থ অগ্রাধিকার পায়, সেটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক।
বাংলাদেশে সড়ক নির্মাণের ব্যয় পৃথিবীর অন্য সব দেশের চেয়ে বেশি। এর পেছনে সরকার বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যে কারণই দেখাক না কেন, সেটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। ২০১৭ সালে বিশ্বব্যাংকের গবেষণায় দেখা যায়, ভারতে প্রতি কিলোমিটার সড়কে ব্যয় ১১ লাখ থেকে ১৩ লাখ ডলার বা (১০০ টাকা ধরে) ১১ কোটি থেকে ১৩ কোটি টাকা। অন্যদিকে চীনে ব্যয় হয় ১৩ লাখ থেকে ১৬ লাখ ডলার বা ১৩ কোটি থেকে ১৬ কোটি টাকা। সওজের তথ্য বলছে, সাধারণত উন্নয়ন সহযোগীদের অর্থায়নে চার লেন সড়ক প্রকল্পে প্রতি কিলোমিটারে খরচ হয় ১৮ কোটি থেকে ৩৪ কোটি টাকা।
১৯২ কিলোমিটার দীর্ঘ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করতে খরচ পড়েছিল প্রতি কিলোমিটার ২১ কোটি টাকা। জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ চার লেন প্রকল্পেও একই ব্যয় হয়েছে। যাত্রাবাড়ী-কাঁচপুর আট লেন প্রকল্পে প্রতি কিলোমিটারে খরচ হয়েছে ২২ কোটি টাকা। রংপুর-হাটিকুমরুল চার লেনে খরচ পড়েছে ৫৫ কোটি টাকা। সিলেট থেকে তামাবিল পর্যন্ত চার লেনের সড়কে খরচ হবে ৬৪ কোটি টাকা। ২০১৮ সালের রেট শিডিউলে নির্মিত ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক চার লেন করতে খরচ হচ্ছে ৮২ কোটি টাকা।
প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, এবার সড়ক ও জনপথ বিভাগ অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় ধরেছে ১৪০ কোটি টাকা। ভাঙ্গা-বেনাপোল রুটের ১২৯ কিলোমিটার দুই লেনের সড়কটি চার লেন করতে খরচ ধরা হয়েছে ১৮ হাজার ৭৭ কোটি টাকা। চার লেনের মহাসড়কের জন্য ৯৬৭ একর জমি অধিগ্রহণের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে খোদ পরিকল্পনা কমিশন।
প্রকল্পটি ভারতের অর্থায়নে বাস্তবায়িত হবে, তাই সেই দেশের বিশেষজ্ঞের পেছনে ১৩৩ কোটি টাকা ব্যয়ের যৌক্তিকতা নেই। তবে এই প্রস্তাবে সবচেয়ে অস্বাভাবিক খাত দেখানো হয়েছে প্রকল্প এলাকায় প্রকৌশলী ও বিশেষজ্ঞদের থাকার জন্য অস্থায়ী ভবন নির্মাণে ১৮৪ কোটি টাকা। প্রতিটি এলাকায় সওজের অফিস ও বাংলো থাকার পরও এত টাকা দিয়ে অস্থায়ী ভবন নির্মাণ করার কী যুক্তি থাকতে পারে!
‘স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুমদখল বিল-২০১৭’ আইন পাস হওয়ার পর থেকে কোনো এলাকায় নতুন সড়ক হবে কিংবা সড়ক চার লেন হবে, এমন তথ্য পেলে প্রভাবশালীরা প্রকল্প শুরুর আগেই সেখানে কম দামে জমি কেনেন। ভাঙ্গা-বেনাপোল সড়কও তার বাইরে নয়। আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি ও রাজনীতিকদের (যাঁদের সবাই সরকারি দলের) সুবিধা দিতেই প্রকল্পের ব্যয় বেশি দেখানো হয়েছে—এমন সন্দেহ অমূলক নয়।
আইন অনুযায়ী বাজারমূল্যের তিন গুণ ক্ষতিপূরণ পাওয়ার কথা। এই সুযোগে একশ্রেণির প্রভাবশালী ব্যক্তি প্রকল্প এলাকায় জমি কেনা শুরু করেন এবং প্রকল্প পাস হওয়ার পর তা কয়েক গুণ বেশি দামে বিক্রি করেন। কেবল সড়ক নির্মাণ নয়, চাঁদপুর বিশ্ববিদ্যালয় করতে গিয়েও জমি কেনাকাটায়ও বাণিজ্য হয়েছে।
প্রস্তাবটি নিয়ে মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে আলোচনা হওয়ার কথা আছে। আমরা মনে করি, কেবল মন্ত্রিসভা কমিটি নয়, বিশেষজ্ঞদের নিয়ে এটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হোক। উন্নয়নের নামে জনগণের করের অর্থ নিয়ে যা ইচ্ছা তা-ই কাণ্ড করার অধিকার কারও নেই।