মূল্যস্ফীতিকে অর্থনীতিবিদেরা যে ‘নীরব ঘাতক’ বলে থাকেন তার যথার্থ যুক্তি রয়েছে। মূল্যস্ফীতির কারণে একদিকে নিত্যপণ্য ও সেবার মূল্য বেড়ে যায়, অন্যদিকে প্রকৃত আয় কমে যাওয়ায় খাদ্য-শিক্ষা-চিকিৎসার মতো অপরিহার্য ব্যয় থেকে কাটছাঁট করতে বাধ্য হন বেশির ভাগ মানুষ। মূল্যস্ফীতির প্রবণতা অব্যাহত থাকলে অনিবার্যভাবেই জীবনযাত্রার মান পড়ে যায়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য থেকেই দেখা যাচ্ছে, গত মে মাসের পর মূল্যস্ফীতি ৯-এর নিচে নামেনি। উচ্চ মূল্যস্ফীতির এই চাপে দেশের নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষেরা যখন দিশাহারা, তখন জ্বালানি ও বিদ্যুতের মতো কৌশলগত পণ্যের ওপর ভর্তুকি তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ফলে দফায় দফায় বাড়ছে জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম।
নতুন বছরের শুরুতে বিদ্যুতের দাম এক দফা বাড়ার পর এ মাসের শুরুর দিনটাতে বিদ্যুতের সেবা মূল্য আরেক দফা বেড়েছে। একই দিনে রান্নার গ্যাস এলপিজির দাম একলাফে বেড়েছে ২৬৬ টাকা এবং শিল্প, বিদ্যুৎ ও বাণিজ্যিক খাতে গ্যাসের বাড়তি দাম কার্যকর হয়েছে। ফলে নতুন মাসের শুরুতেই ভোক্তার ঘাড়ের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মূল্যবৃদ্ধির বোঝা এসে চাপল। প্রশ্ন হলো অব্যাহত মূল্যস্ফীতিতে এমনিতেই চিড়েচ্যাপটা হওয়া নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা নতুন এই চাপ কতটা নিতে সক্ষম হবে?
বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব এরই মধ্যে বাজারে পড়তে শুরু করেছে। গত শুক্রবার প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, আগেই যেসব নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছিল, সরকারি সিদ্ধান্তে সেগুলোর দাম ঊর্ধ্বমুখী হতে শুরু করেছে। সাধারণ মানুষের প্রোটিন ও পুষ্টির বড় উৎস ডিমের দাম যেমন চড়তে শুরু করেছে, তেমনি ব্রয়লার মুরগির দামও অনেকটা বেড়েছে। তেলাপিয়া, পাঙাশের মতো মাছ কিংবা অ্যাংকর ডালও সাধারণ ক্রেতার ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে।
ভরা মৌসুমেও শীতের সবজির দাম এখন অনেকের সাধ্যের বাইরে, আর কাঁচা মরিচ, পেঁয়াজ, রসুন, আদা ও ভোজ্যতেলের দামও বেশ চড়া। মোটা চালের দাম স্থিতিশীল থাকলেও ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসের তুলনায় তা অনেকটাই বেশি। শুল্ক কমিয়ে আমদানির সুযোগ বাড়ানোর পরও চালের দাম কমেনি। এক বছরের ব্যবধানে আটার দাম বেড়েছে ৬৬ শতাংশ।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ-সংকটে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে ৪৭০ কোটি নিচ্ছে সরকার। এর বিপরীতে ৩৮টি পূরণ করতে হচ্ছে। আইএমএফ যেসব সংস্কারের শর্ত দিয়েছে, বাংলাদেশের অর্থনীতির খাতগুলোর এ ধরনের সংস্কার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছেন অর্থনীতিবিদেরা। কিন্তু নীতিনির্ধারকেরা তাতে কোনো কর্ণপাত করেননি এত দিন। অর্থনীতি যখন একটি ক্রান্তিকালের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, সে সময় একবারে এতগুলো সংস্কার অনিবার্যভাবেই অর্থনীতিতে বড় চাপ তৈরি করবে। মূল্যস্ফীতির বোঝা ও নিম্ন ও মধ্যবিত্তের দুর্দশা যে শিগগির কাটছে না, সেটা বলা বাহুল্য।
আইএমএফ সংস্কারের একটি পথরেখা দিয়েছে। কিন্তু সংস্কার কর্মসূচি যথাযথ ও যৌক্তিক হচ্ছে কি না এবং এর সুফল সাধারণ মানুষ পাচ্ছেন কি না, এসব বিষয়ে তীক্ষ্ণ নজরদারি ও তদারকি প্রয়োজন। সাধারণ ভোক্তাদের ঘাড়ে বোঝা চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা সব সময় দেখা যায়। সবার আগে এই একচোখা নীতির সংস্কার প্রয়োজন। মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষের দুর্দশা লাঘবে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির পরিধি ও সুবিধাভোগীর সংখ্যা বাড়ানো প্রয়োজন। প্রকৃত ভুক্তভোগীর কাছে যেন তা পৌঁছায়, সে ব্যবস্থা নিতে হবে। মূল্যস্ফীতির বোঝা কমানো ও সাধারণ মানুষের দুর্দশার লাঘব করাই এ সময়কার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু সে ক্ষেত্রে সরকারের কর্মকৌশল এখনো দৃশ্যমান নেই।