সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

খেলাপি ঋণ আদায়ে সরকার কী করছে

জাতীয় সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট আলোচনায় অংশ নিয়ে বেশ কয়েকজন সংসদ সদস্য আর্থিক খাতের ভঙ্গুরতা ও অব্যবস্থা সম্পর্কে অর্থমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তাঁদের বক্তব্য হলো, গুটিকয় ঋণখেলাপি ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করে দিয়ে ব্যাংক ও অর্থনীতিকে মহাবিপর্যয়ের মধ্যে ঠেলে দিয়েছেন।

খেলাপি ঋণ নিয়ে বছরের পর বছর আলোচনা হয়। বিতর্ক হয়। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে খেলাপি ঋণ আদায়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না। এর একটি কারণ হতে পারে ঋণখেলাপিরা সরকারের চেয়েও ক্ষমতাবান, যঁাদের ওপর হাত দেওয়ার সাহস কারও নেই।

গত রোববার স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য এ কে আজাদ জাতীয় সংসদে ঋণখেলাপিদের নামের তালিকা প্রকাশের দাবি জানিয়ে বলেছেন, এই ঋণখেলাপিরাই ব্যাংকের টাকা লুণ্ঠন করে বিদেশে পাচার করেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে খেলাপি ঋণ ১ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকা বলা হলেও মূলত খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫ লাখ কোটি টাকা।

এ কে আজাদ তাঁর বাজেট–বক্তৃতায় একটি মৌলিক প্রশ্ন তুলেছেন। জনপ্রশাসন খাতে ব্যয় বাজেটের ২২ দশমিক ১ শতাংশ, যা ২ লাখ ৯৭ হাজার ৩৮৮ কোটি টাকা। অথচ আমাদের উন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৮১ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা। উন্নয়ন বাজেটের চেয়ে জনপ্রশাসন খাতে ব্যয় বেশি হলে জনগণের ভাগ্যের পরিবর্তন কীভাবে সম্ভব? সরকার পরিচালনে যে ৫ লাখ ৬ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা ধরা হয়েছে, তার মধ্যে ১ লাখ কোটি টাকার বেশি দিতে হবে ঋণের সুদ বাবদ।

যেখানে দেশে ডলার–সংকট চলছে, বিদেশি কোম্পানির লভ্যাংশ ঠিকমতো পরিশোধ করা যাচ্ছে না, এসি ল্যান্ড ও ইউএনওদের জন্য কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে গাড়ি কেনার কী যৌক্তিকতা থাকতে পারে বলে এ কে আজাদ যে প্রশ্ন তুলেছেন, সেটা যথার্থ বলেই মনে করি। অর্থনৈতিক সংকটের সময় অনুৎপাদনশীল খাতে যথাসম্ভব কম খরচ করতে হবে।

সংসদ সদস্য এ কে আজাদ সংসদে ঋণখেলাপিদের তালিকা প্রকাশের যে দাবি জানিয়েছেন, আমরা তা সমর্থন করি। ঋণখেলাপিদের তালিকা প্রকাশ করা উচিত এ কারণে যে জনগণ জানতে পারবে, ব্যাংকে তঁাদের সঞ্চিত অর্থ লোপাট করে দিয়েছেন। তবে এ–ও সত্য যে এ ক্ষেত্রে তালিকা প্রকাশই যথেষ্ট নয়। আ হ ম মুস্তফা কামাল অর্থমন্ত্রী থাকাকালে দুবার ঋণখেলাপিদের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছিল। কিন্তু তাতে খেলাপি ঋণ কমেনি; বরং গত এক বছরে আরও বেড়েছে।

ঋণখেলাপিরা কে কোথায় আছেন, ঋণের বিপরীতে তঁারা যে সম্পদ বন্ধক রেখেছেন, সেই সম্পদ খুঁজে বের করা দরকার। ব্যাংকের অসাধু কর্মকর্তাদের সঙ্গে ঋণখেলাপিদের যোগসাজশেরও বিস্তর প্রমাণ আছে। এই সম্পাদকীয় লেখার সময়ই খবর এল বেসরকারি খাতের প্রিমিয়ার ব্যাংকের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ চার কর্মকর্তা ভুয়া ঋণের মাধ্যমে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এ ঘটনায় দুর্নীতি দমন কমিশনের আবেদনের (দুদক) পরিপ্রেক্ষিতে আদালত তঁাদের বিদেশ যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন।

পূর্বসূরির মতো বর্তমান অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীও ঋণখেলাপিদের সদুপদেশ দিয়ে খেলাপি ঋণ আদায় করতে চান। কিন্তু তাঁর জানা উচিত যে চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনি। ঋণখেলাপিদের সদুপদেশ দিয়ে লাভ নেই। তালিকা করে তাঁদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। যেসব ঋণখেলাপি ইতিমধ্যে দেশ ছড়ে পালিয়েছেন, তঁাদের দেশে ফেরত এনে অর্থ উদ্ধার করার দায়িত্ব সরকারেরই।