সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

সব বিভাগের কর্মীদের জবাবদিহির মধ্যে আনুন

বিচার বিভাগীয় সব কর্মকর্তা ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের হিসাব বিবরণী দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বুধবার এ তথ্য জানিয়ে বলেছেন, সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শক্রমে বিচার বিভাগীয় সব কর্মকর্তা ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের দেশে-বিদেশে থাকা স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের হিসাব বিবরণী ১০ কর্মদিবসের মধ্যে দাখিল করতে হবে।

যখন প্রশাসনের সর্বস্তরে দুর্নীতির মচ্ছব চলছে, তখন আইন উপদেষ্টার এই ঘোষণা জনমনে কিছুটা হলেও আশা জাগাবে। আমরা তাঁর এই ঘোষণাকে স্বাগত জানাই। সরকারি কর্মকর্তাদের সম্পদের হিসাব নিয়ে আগের সরকারের আমলেও আলোচনা হয়েছে। কিন্তু যখনই তঁাদের জবাবদিহির মধ্যে আনার উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলা হয়, তখনই নানা বাহানা তোলা হয়েছে। কোনো সাধারণ নাগরিকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এলে দুদক অনায়াসে মামলা করতে পারে। কিন্তু সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা করতে হলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হয়। এক দেশে দুই আইন চলতে পারে না। এ ধরনের মামলা করার ক্ষেত্রে পূর্বানুমতির বিধান তুলে দেওয়া উচিত।

জুলাই মাসের শুরুতে সরকারি কর্মচারী ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের সম্পদ বিবরণীর ঘোষণা এবং সময়ে সময়ে তা দাখিল-সংক্রান্ত বিধি কঠোরভাবে মানতে নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। আদালত বলেছেন, ১৯৭৯ সালের সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালার ১৩ বিধিটি কঠোরভাবে মানতে নির্দেশ দেওয়া হলো। ওই আইনে বলা আছে, প্রত্যেক সরকারি কর্মচারী চাকরিতে প্রবেশের সময় যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সরকারের কাছে তাঁর বা পরিবারের সদস্যদের মালিকানাধীন বা দখলে থাকা শেয়ার, সার্টিফিকেট, সিকিউরিটি, বিমা পলিসি ও মোট ৫০ হাজার টাকা বা ততোধিক মূল্যের অলংকারসহ স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তির ঘোষণা করবেন। এ ছাড়া আইনে প্রত্যেক সরকারি কর্মচারী প্রতি পাঁচ বছর অন্তর প্রদর্শিত সম্পত্তির হ্রাস-বৃদ্ধির হিসাব বিবরণী যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সরকারের কাছে জমা দেওয়ার কথাও আছে।

অতীব দুঃখের বিষয়, আইন পাসের ৪৫ বছর পার হলেও এর কার্যকারিতা নেই। ক্ষমতাসীনেরা নির্বাচনের আগে জনপ্রতিনিধি ও সরকারি কর্মকর্তাদের সম্পদের হিসাব দেওয়ার গালভরা প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু নির্বাচনের পর সেটি বাস্তবায়ন করেন না। ২০০৮ সালে নবম সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে যে পাঁচটি ক্ষেত্রকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়, তাতে ‘সুশাসন প্রতিষ্ঠা’ শীর্ষক ৫.৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়, ‘প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার সদস্য এবং সংসদ সদস্য ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের সম্পদের হিসাব ও আয়ের উৎস প্রতিবছর জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে।’

কিন্তু ক্ষমতায় আসার পরই সরকারের নীতিনির্ধারকেরা উল্টোরথে যাত্রা শুরু করেন। নির্বাচনী জনপ্রতিনিধিরা যখন নিজেদের অঙ্গীকার থেকে সরে আসেন, তখন সরকারি কর্মকর্তারাও সম্পদের হিসাব দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন না। বহু বছর ধরে জবাবদিহিহীনতা চলে আসার কারণে জনপ্রশাসন দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। বেনজীর ও মতিউর-কাণ্ডই জনপ্রশাসনের একমাত্র আর্থিক কেলেঙ্কারি নয়। জনগণের করের অর্থে বেতন-ভাতা নিয়ে অনেক সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীই দুর্নীতির মহারাজে পরিণত হয়েছেন।

এ অবস্থার অবসানের জন্য কেবল বিচার বিভাগের নয়, জনপ্রশাসনের সব বিভাগের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব নিতে হবে। কোনো রাজনৈতিক সরকার কাজটি করতে পারেনি, অন্তর্বর্তী সরকার পারলে আমরা মোবারকবাদ জানাব।