সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

দক্ষ জনসম্পদ গড়ে তোলাই বড় চ্যালেঞ্জ

বাংলাদেশ জনমিতির লভ্যাংশ বা পপুলেশন ডিভিডেন্ড পাচ্ছে বলে সরকারের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে একধরনের আত্মতুষ্টি রয়েছে। তাঁদের কেউ কেউ বাড়তি জনসংখ্যা বোঝা নয়, আশীর্বাদ বলে প্রচার করছেন। তাঁদের এই প্রচার ও বাস্তবতার মধ্যে বিরাট ফারাক আছে।

যেকোনো দেশে মোট কর্মক্ষম জনসংখ্যা যদি কর্মক্ষমতাহীন জনসংখ্যার চেয়ে বেশি হয়, সেই অবস্থাকে জনমিতিক লভ্যাংশ হিসেবে ধরা হয়। তবে বিষয়টি কেবল সংখ্যার ওপর নির্ভর করে না। দেখতে হবে সেই সংখ্যাকে আমরা কতটা দক্ষ ও যোগ্য করে তুলতে পেরেছি।

জনসংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ সুবিধাজনক অবস্থানে থাকলেই হবে না, তাঁদের সুস্থ ও দক্ষ নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার সুযোগ তৈরি করতে যে শিক্ষা-স্বাস্থ্যসেবাসহ যে সামাজিক সুরক্ষা প্রয়োজন, সেটাও নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম যথার্থই বলেছেন, উন্নয়নের লক্ষ্য হলো সব মানুষের জীবনের গুণগত মানের উন্নয়ন। এ ক্ষেত্রে সংখ্যাগত বা পরিমাণগত অবস্থান থেকে সরে গিয়ে গুণগত অবস্থার দিকে এগোনো জরুরি।

২০১৯ সালের ১২-১৪ নভেম্বর কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবিতে অনুষ্ঠিত জনসংখ্যা ও উন্নয়নবিষয়ক ঐতিহাসিক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে (আইসিপিডি) তিন শূন্য লক্ষ্যমাত্রা পূরণের ওপর জোর দেওয়া হয়—শূন্য মাতৃমৃত্যু হার, যৌন ও জেন্ডারভিত্তিক নির্যাতন শূন্যে নামিয়ে আনা এবং ক্ষতিকারক চর্চা নির্মূল করা। এই তিন লক্ষ্যমাত্রার কোনোটিই আমরা পূরণ করতে পারিনি। বরং বাল্যবিবাহের কারণে অনেক সম্ভাবনাময় জীবনই হারিয়ে যায়। ২০৩০ সালের মধ্যে সেটা পারব, সেই নিশ্চয়তাও নেই। তাহলে জনমিতির লভ্যাংশ আশা করা যায় কীভাবে?

বাংলাদেশে প্রথম জনসংখ্যা নীতি প্রণীত হয় ১৯৭৬ সালে। এরপর ১৯৯৪ ও ২০১২ সালে আরও দুবার জনসংখ্যা নীতি করা হয়। এই তিন নীতিতেই জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ওপর জোর দেওয়া হয়েছিল। এখন নতুন করে জনসংখ্যা নীতি হালনাগাদ করার যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তাতে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের চেয়ে ব্যবস্থাপনার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রতিস্থাপনযোগ্য প্রজনন হারে পৌঁছানোর আগে কার্যকর পরিবার পরিকল্পনা নীতি অব্যাহত রাখা জরুরি বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

ব্যবস্থাপনা বলতে যদি প্রত্যেক নাগরিকের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার পাশাপাশি উপযুক্ত কাজের সুযোগের নিশ্চয়তা হয়, সেটা অবশ্যই সমর্থনযোগ্য। জনসংখ্যা নীতি বাস্তবায়নে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো হিসেবে জাতীয় জনসংখ্যা পরিষদ গঠন করা হয়েছে। জনসংখ্যা নীতিতে কোনো রকম সংযোজন-বিয়োজন করতে হলে এই পরিষদই নির্দেশনা দিয়ে থাকে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো ২০১০ সালের পর এই পরিষদের আর কোনো বৈঠক হয়নি।

জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের একসময় ‘ছেলে হোক মেয়ে হোক দুটি সন্তানই যথেষ্ট’ স্লোগানকে গুরুত্ব দেওয়া হতো। পরে ঠিক করা হলো ‘দুটি সন্তানের বেশি নয়, একটি হলে ভালো হয়।’ আর্থসামাজিক জীবনে অন্যান্য ক্ষেত্রে পুরুষেরা পিছিয়ে থাকলেও জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণের ক্ষেত্রে নারীই এগিয়ে আছে। প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী, দম্পতিদের মধ্যে জন্মনিয়ন্ত্রণের আধুনিক পদ্ধতি গ্রহণের হার ৫৫। অথচ মাত্র ৯ শতাংশ পুরুষ এটি গ্রহণ করে।

আমরা মনে করি, প্রতিস্থাপনযোগ্য প্রজনন হার নিশ্চিত করা ও ব্যবস্থাপনা দুই ক্ষেত্রেই আমাদের নজর বাড়াতে হবে। বর্তমানে যে জনসংখ্যা আছে, তার ন্যূনতম মৌলিক চাহিদা পূরণই যেখানে কঠিন, সেখানে জনসংখ্যা আরও বাড়লে সেটা জনমিতিক লভ্যাংশ না হয়ে বিপরীতটা হওয়ার শঙ্কাই বেশি। তাই জনশক্তিকে যোগ্য ও দক্ষ করে তোলার পাশাপাশি জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারকেও ব্যবস্থাপনা সক্ষমতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ রাখতে হবে। প্রত্যেক নাগরিকের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবাসহ সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।