সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

ইউজিসির প্রস্তাব আমলে নেওয়া হোক

বেশ কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে যখন নানা অনিয়মের অভিযোগ আসছে, দলীয় রাজনীতির প্রতি তাঁদের আনুগত্যের মাত্রা যখন ছাড়িয়ে যাচ্ছে, তখন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ তিনটি পদ উপাচার্য, সহ–উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষের পদ খ্যাতনামা শিক্ষকদের পুল গঠনের মাধ্যমে পূরণের প্রস্তাব দিয়েছে।

ইউজিসির ২০২২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে উচ্চশিক্ষার জন্য যে ১৪ দফা সুপারিশ করা হয়েছে, তার মধ্যে উপাচার্য, সহ–উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ নিয়োগের বিষয়টিও এসেছে। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ও উচ্চশিক্ষার নানা তথ্য নিয়ে প্রতিবছর সরকারের কাছে ইউজিসি প্রতিবেদন দিয়ে থাকে। কিন্তু ২০২২ সালের প্রতিবেদন এক বছর পর কেন দেওয়া হবে, সেটি বোধগম্য নয়।

২০২২ সালের তথ্য–উপাত্ত নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদন কেন ২০২৩ সালের প্রথম তিন মাসের মধ্যে দেওয়া হবে না? কেননা যখন তাদের সুপারিশ প্রকাশিত হয়, তখন পরিস্থিতি অনেকটাই বদলে যায়।

১৯৭৩-এর অধ্যাদেশ অনুযায়ী স্বায়ত্তশাসিত চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ হওয়ার কথা নির্বাচনের মাধ্যমে। প্যানেলভুক্ত তিন শিক্ষকের তালিকা আচার্যের কাছে পাঠানো হয়। আচার্য সেই প্যানেল থেকে একজনকে বাছাই করে নেন (আচার্য বাছাই করলেও সিদ্ধান্তটি নিয়ে থাকেন নির্বাহী বিভাগের পরামর্শে)। চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগর) এই বিধান চালু আছে।

বাকিগুলোয় নিয়োগ হয়ে থাকে সরকার বা নির্বাহী বিভাগের খেয়ালখুশিমতো। বর্তমানে অনুমোদিত বিশ্ববিদ্যালয় ১৬৯টি। এর মধ্যে ৫৫টি সরকারি ও ১১৪টি বেসরকারি। উল্লিখিত যে চারটিতে নির্বাচনের মাধ্যমে উপাচার্য নিয়োগের বাধ্যবাধকতা আছে, সেখানেও সেটা মানা হয় না। নির্বাহী বিভাগ আগে নিয়োগ দিয়ে পরে নির্বাচনের মাধ্যমে সেটি জায়েজ করা হয়।

বাস্তবতা হলো উপাচার্য ও সহ–উপাচার্য পদের জন্য প্রায় প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের মধ্যে দৌড়ঝঁাপ শুরু হয়। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক আনুগত্যই অগ্রাধিকার পেয়ে থাকে। শিক্ষাগত ও প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা-উৎকর্ষ বিবেচনায় আনা হয় না। এমনকি এই রাজনৈতিক আনুগত্যের পুরস্কার দিতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্র বিশ্ববিদ্যালয় আইনকেও অগ্রাহ্য করা হয়েছে। সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান বিষয়ের বাইরের শিক্ষকদের উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগে রাজনৈতিক বিবেচনা চলে আসছে বহু বছর ধরে। একানব্বই–পরবর্তী কোনো শাসনামলেই এর ব্যতিক্রম দেখা যায়নি। যখন যে দল ক্ষমতায় আসে, সেই দলের প্রতি অনুগত শিক্ষকেরাই উপাচার্য পদে নিয়োগ পেয়ে থাকেন। আওয়ামী লীগ একটানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকায় দলীয়করণের পাল্লাটাও ভারী। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া উপাচার্যরা আইনকানুনের সামান্যই তোয়াক্কা করেন।

এ অবস্থায় কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ আশা করা যায় না। সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সার্চ কমিটি গঠন করে উপাচার্য নিয়োগের একটি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, সেটিও সফল হয়নি।

সে ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন খ্যাতনামা শিক্ষকদের পুল থেকে উপাচার্য, সহ–উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ নিয়োগের যে সুপারিশ করেছে, তা বিবেচনার দাবি রাখে। তবে এখানেও সমস্যা আছে। পুলটা তৈরি হবে কাদের নিয়ে? পুল গঠনে যদি রাজনৈতিক প্রভাব কাজ করে, তবে উপাচার্য, সহ–উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ পদে উপযুক্ত প্রার্থী পাওয়া যাবে না।