সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশ

মামলা দিয়ে নিরপরাধীদের হয়রানি বন্ধ হোক

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে হত্যাকাণ্ডসহ অন্যান্য অপরাধ ঘিরে যেসব মামলা হচ্ছে, তার বেশির ভাগই সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণহীন বলে অভিযোগ উঠেছে। হত্যা কিংবা অন্য কোনো ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে ন্যূনতম নিয়মনীতি অনুসরণ করা হয়নি। এসব ঢালাও মামলা নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে উদ্বেগ ও সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে ১৩ সেপ্টেম্বর পুলিশ সদর দপ্তর যে নির্দেশনা দিয়েছে, সেটাকে ইতিবাচক বলে মনে করি।

তদন্তে কোনো আসামির সম্পৃক্ততা পাওয়া না গেলে মামলা থেকে তাঁর নাম প্রত্যাহারের ব্যবস্থা করতে বলেছে পুলিশ সদর দপ্তর। একই সঙ্গে সঠিক তথ্যপ্রমাণ ছাড়া এসব মামলায় কোনো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে গ্রেপ্তার করা যাবে না বলেও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। যাচাই-বাছাই না করে মিথ্যা বা ভুয়া মামলা দিয়ে নিরপরাধ মানুষকে হয়রানি না করার অনুরোধ এসেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকেও।

পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশনাকে আমরা স্বাগত জানাই। সেই সঙ্গে এটাও বলব যে এসব মামলা কীভাবে হলো, কারা এর পেছনে ছিলেন, সেটাও খতিয়ে দেখা হোক। জুলাই–আগস্টের ছাত্র–জনতার আন্দোলন দমাতে বিগত সরকার যে চরম নিষ্ঠুরতার আশ্রয় নিয়েছিল, তার বিচার অবশ্যই হতে হবে। কিন্তু বিচারের নামে নিরপরাধ মানুষকে হয়রানি করার অধিকার কারও নেই।

উল্লেখ্য, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও দলটির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে সারা দেশের বিভিন্ন থানা ও আদালতে বহু মামলা হয়েছে। এসব মামলায় শিক্ষাবিদ, ইতিহাসবিদ, শিল্পী–সংস্কৃতিকর্মী, লেখক-সাংবাদিকদের
নামও জুড়ে দেওয়া হয়েছে আগের সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা থাকার কারণে। কোনো সরকারকে সমর্থন বা বিরোধিতা করা নাগরিকের একান্তই তাঁর নিজস্ব বিষয়। দেখতে হবে তিনি আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে কোনো অপরাধমূলক কাজে জড়িত হয়েছেন কি না। যদি জড়িত হয়ে থাকেন, তথ্যপ্রমাণসহ তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হতে হবে। ঢালাও মামলায় জড়ানো কেন? 

অনেক মামলার বাদী বলেছেন, তিনি আসামিদের চেনেন না। এর অর্থ এসব মামলায় যাঁদের বাদী করা হয়েছে, সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এসব ঘটনায় ভুক্তভোগী পরিবারগুলো মামলা করেছে। ভুক্তভোগী পরিবার বা স্বজনেরা মামলা করলে তাঁরা আসামিকে চিনতেন।

আইনবিশেষজ্ঞরা এসব মামলাকে আওয়ামী লীগ আমলের গায়েবি মামলার সঙ্গেও তুলনা করেছেন। সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না প্রথম আলোকে বলেন, ‘ফৌজদারি মামলা হলো স্থান, সময় ও ঘটনা সংঘটনের স্থান। এই তিনটার হেরফের হলে তাহলে আর মামলা টেকে না। ফৌজদারি মামলায় এফআইআরকে বাইবেল বলে বিবেচনা করা হয়। অর্থাৎ এর সামান্য দাঁড়ি, কমা পরিবর্তন হলে এটা বাদ। তদন্তে আরও নতুন নতুন তথ্য আসতে পারে। কিন্তু এক মামলায় দুই এফআইআর হতেই পারে না।’

অথচ আমরা দেখেছি ৫ আগস্টের আগে যে হত্যা মামলায় বিএনপি-জামায়াতের নেতাদের আসামি করা হয়েছিল, ৫ আগস্টের পর সেই মামলায় আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপিদের আসামি করা হয়েছে এবং তাঁদের রিমান্ডেও নেওয়া হয়েছে। সরকার পরিবর্তনের পর মামলার এফআইআর বদলে যেতে পারে না। পুলিশ কর্মকর্তাদের এই আচরণ কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। 

পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশনার পর আমাদের প্রত্যাশা, ঢালাও মামলায় আর কাউকে অযথা আসামি করা হবে না। আগের মামলাগুলো দ্রুত যাচাই-বাছাই করে ঘটনার সঙ্গে কোনোভাবে যুক্ত নন, এমন আসামিদের বাদ দেওয়া হবে।

আমরা চাই হত্যা, দুর্নীতিসহ সব অপরাধের বিচার হোক। কিন্তু অপরাধীকে শনাক্ত না করে এ রকম গয়রহ মামলা করলে যেমন নিরপরাধ মানুষ হয়রানির শিকার হবেন, তেমনি ন্যায়বিচারের পথও রুদ্ধ হবে।