সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

শিক্ষার প্রতি আর কত উপেক্ষা

৪ মে প্রথম আলোয় ৪০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঘুরে রাজধানীর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর যে চালচিত্র তুলে ধরা হয়েছে, তাকে উদ্বেগজনক বললেও কম বলা হবে। অনেক বিদ্যালয়ের কোনোটির জমি ও ভবন বেদখল হয়ে গেছে, কোনোটিতে শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষ ও শিক্ষকদের বসার ঘর নেই। নেই খেলার মাঠ, শৌচাগার কিংবা পানীয় জলের ব্যবস্থা। অনেক বিদ্যালয়ের দেয়াল ও ছাদ ধসে গেছে, বর্ষার দিনে মেঝেতে পানি জমে যায়। যেকোনো সময় মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। অনেক বিদ্যালয়ের মাঠে বসানো হয়েছে ওয়াসার পানির পাম্প। 

মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ৬৫ হাজার ৬২০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে সারা দেশে। এর মধ্যে রাজধানীতে ৩৪২টি। এর মধ্যে ২১টি বিদ্যালয়ের জমি ও চারটির ভবন বেদখল হয়ে যাওয়ার খবর আমাদের বিস্মিত করে। ক্ষমতার ছত্রচ্ছায়ায় এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তিরাই দখলের কাজটি করে থাকেন। দেশে আইনের শাসন থাকলে এভাবে সরকারি সম্পত্তি কেউ দখল করতে পারতেন না। আমরা অনেক দখলের খবর পাচ্ছি বা উদ্ধারের চেষ্টা করছি—কর্তাব্যক্তিদের মুখে এ ধরনের আশ্বাসবাণী আমরা শুনতে চাই না। দখল হয়ে যাওয়া জমি ও ভবন উদ্ধার করেই তাঁরা প্রমাণ করুন দেশের শিক্ষা ও শিক্ষার্থীদের প্রতি তাঁদের দায়বদ্ধতা আছে। 

প্রতিবেদন থেকে আরও জানা যায়, ২০১৫ সালে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন মন্ত্রী ওয়ারীর একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিদর্শন করে শিগগিরই নতুন ভবন নির্মাণের ওয়াদা করেছিলেন। অদ্যাবধি সেই ভবন নির্মিত হয়নি। শিক্ষার্থীরা ঝুঁকি নিয়ে সেখানে ক্লাস করে। এক মন্ত্রীর স্থলে আরেক মন্ত্রী আসেন, এক সচিবের স্থলে আরেক সচিব, কিন্তু আলোঝলমলে রাজধানী শহরের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর দুরবস্থা দূর হয় না। 

১৯৭৩ সালে প্রাথমিক শিক্ষাকে সর্বজনীন ও বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। কিন্তু এখন প্রাথমিক শিক্ষাটা অধিক মাত্রায় বাণিজ্যিকীকরণ হয়েছে। বিত্তবান ও সামর্থ্যবান মানুষ বিপুল অর্থ খরচ করে সন্তানদের বেসরকারি বিদ্যালয়ে পড়ান। দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষের তো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। 

রাজধানীর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শোচনীয় অবস্থা হয়েছে মূলত দুটি কারণে। প্রথমত, এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গরিব মানুষের ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করে। ফলে গরিবদের বিদ্যালয়ের প্রতি সরকার তথা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সীমাহীন উপেক্ষা। এ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, কর্তাব্যক্তি বা বিত্তবানদের সন্তানেরা এসব বিদ্যালয়ে পড়লে তাঁরা অধিক মনোযোগ দিতেন। দ্বিতীয়ত, স্থানীয় প্রভাবশালীরা চান না সেখানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো ভালোভাবে চলুক। সরকারি বিদ্যালয় উঠে গেলে তার জমি ও ভবন তাঁরা অনায়াসে দখলে নিতে পারবেন।

তাই রাজধানী শহরের যেসব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জমি ও সম্পত্তি দখল হয়ে গেছে, সেগুলো দ্রুত উদ্ধার করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ন্যূনতম অবকাঠামো নিশ্চিত করতে হবে। বিদ্যালয়গুলোর দৃষ্টিনন্দন ভবন নির্মাণের জন্য ১ হাজার ১৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প নিয়েছে সরকার। যার বাস্তবায়নকাল ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। কিন্তু ২০২৩ সাল পর্যন্ত মাত্র ১০টি বিদ্যালয়ে এ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে, যা খুবই হতাশাজনক। পাশাপাশি এটিও বলতে হয় যে কোটি মানুষের এই রাজধানী শহরে মাত্র ৩৪২টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কোনোভাবেই যথেষ্ট নয়। বিদ্যালয়ের সংখ্যা আরও বাড়ানো হোক। মান ও পরিবেশের উন্নয়ন ঘটিয়ে নগরবাসীকে সন্তানদের পড়াশোনার জন্য সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানমুখী করার নজির আমাদের পাশের দেশের রাজধানী শহর দিল্লিতেই আছে।    

রাজধানীর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এ দুরবস্থায় প্রতীয়মান হয় দেশের অন্যান্য এলাকা, বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলের বেশির ভাগ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবস্থাও ভালো নয়। আশা করি, সরকার শিক্ষার এ মৌলিক সমস্যা সমাধানে টেকসই ও কার্যকর পদক্ষেপ নেবে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো দুরবস্থায় রেখে শিক্ষার উন্নয়ন যে অসম্ভব, সেটাও নীতিনির্ধারকদের বুঝতে হবে।